১) ইস্তিখারা (استخارة) মানে ‘কল্যাণ চাওয়া’। সব সময়, সব বিষয়ে পুরোপুরি আত্মবিশ্বাস নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায়? মানুষ তো গায়েব জানে না। আগামী কাল কী হবে, সেটাও তার পক্ষে বলা সম্ভব নয়। এমনকি নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-ও গায়েব জানতেন না। আল্লাহ তা‘আলা তাকে গাইবের সংবাদ জানালে, তখন জানতে পারতেন। এই জানার ওপর ভিত্তি করেই প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন। এবং সেটা শতভাগ সঠিক সিদ্ধান্তই হতো।
২) জটিল ও কঠিন মুহূর্তে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হয়। কিন্তু কোনদিকে পা ওঠাব, ঠিক করে ওঠা মুশকিল হয়ে পড়ে। পেরেশানি আর হয়রানির অন্ত থাকে না। মাঝে মধ্যে এমনও হয়, সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে, ভাল করে যাচাই-বাছাই করার পর বের হয়, কাজটাতে ভালমন্দ উভয় দিকই সমান সমান। এখন কী করবো? আকস্মিক বিপদের সম্মুখীন হয়েছি, আশেপাশে পরামর্শ করার মতো আপনজন নেই, এমন এক জটিল পরিস্থিতিতে পড়েছি, কী যে করব, কোন দিকে যাবো, কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না।
৩) এ-ধরনের সমস্যার সমাধান পেয়ারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দিয়ে গেছেন। খুবই সহজ একটা সমাধান। চমৎকার এক সুন্নাত।
عَنْ جَابِرِ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا، قَالَ: كَانَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم يُعَلِّمُنَا الاسْتِخَارَةَ فِي الأُمُورِ كُلِّهَا، كَمَا يُعَلِّمُنَا السُّورَةَ مِنَ القُرْآنِ، يَقُولُ: “إِذَا هَمَّ أَحَدُكُمْ بِالأَمْرِ، فَلْيَرْكَعْ رَكْعَتَيْنِ مِنْ غَيْرِ الفَرِيضَةِ، ثُمَّ لِيَقُلْ:
হযরত জাবের রাঃ বলেছেন, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে সমস্ত বিষয়ে ‘ইস্তিখারাহ’ শিক্ষা দিতেন। আমাদেরকে কুরআন কারীমের সূরা যেমন গুরুত্ব দিয়ে শেখাতেন, ইস্তিখারাও হুবহু একই গুরুত্ব দিয়ে শেখাতেন। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতেন,
‘তোমরা কোনও বিষয়ে উদ্বিগ্ন বা চিন্তিত হয়ে পড়লে, দুই রাকাত নফল নামায পড়ে নিবে। তারপর ইস্তিখারার দু‘আ পড়বে। (বুখারী ৭৩৯০)
اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْتَخِيرُكَ بِعِلْمِكَ وَأَسْتَقْدِرُكَ بِقُدْرَتِكَ، وَأَسْأَلُكَ مِنْ فَضْلِكَ العَظِيمِ، فَإِنَّكَ تَقْدِرُ وَلاَ أَقْدِرُ، وَتَعْلَمُ وَلاَ أَعْلَمُ، وَأَنْتَ عَلاَّمُ الغُيُوبِ، اللَّهُمَّ إِنْ كُنْتَ تَعْلَمُ أَنَّ هَذَا الأَمْرَ خَيْرٌ لِي فِي دِينِي وَمَعَاشِي وَعَاقِبَةِ أَمْرِي -أَوْ قَالَ: عَاجِلِ أَمْرِي وَآجِلِهِ- فَاقْدُرْهُ لِي وَيَسِّرْهُ لِي، ثُمَّ بَارِكْ لِي فِيهِ، وَإِنْ كُنْتَ تَعْلَمُ أَنَّ هَذَا الأَمْرَ شَرٌّ لِي فِي دِينِي وَمَعَاشِي وَعَاقِبَةِ أَمْرِي -أَوْ قَالَ: فِي عَاجِلِ أَمْرِي وَآجِلِهِ- فَاصْرِفْهُ عَنِّي وَاصْرِفْنِي عَنْهُ، وَاقْدُرْ لِي الخَيْرَ حَيْثُ كَانَ، ثُمَّ أَرْضِنِي
উচ্চারণ- আল্লাহুম্মা ইন্নী আস্তখিরুকা বিইলমিকা। ওয়া আস্তাক্বদিরুকা বিক্বুদরাতিকা। ওয়া আসয়ালুকা মিন ফাদলিকাল আজি-ম। ফাইন্নাকা তাক্বদিরু ওয়ালা আক্বদিরু। ওয়া তা’লামু ওয়ালা আ’লামু। ওয়া আন্তা আ’ল্লামুল গুয়ু-ব। আল্লাহুম্মা ইন্ কুন্তা তা’লামু আন্না হাযাল আমরা খাইরাল্ লী ফী দ্বীনি ওয়া মায়া’শী ওয়া আ’ক্বিবাতু আমরী। আও ক্ব-লা আ’-জিলি আমরী ওয়া আ’-জিলিহী। ফাক্বদির্ হু লী ওয়া ইয়াচ্ছির হু লী। ছুম্মা বা-রিকলী ফি-হি। ওয়া ইন্ কুন্তা তা’লামু আন্না হা-যাল আমরা শার্রুল লী- ফি- দ্বীনি ওয়া মায়া’শী ওয়া আ’ক্বিবাতু আমরী। আউ ক্ব-লা ফি আ’-জিলি আমরী ওয়া আ’-জিলিহী। ফাস্ রিপহু আ’ন্নী ওয়াছ রিফনী আ’নহু। ওয়াক্ব দির্ লীইয়াল খাইরা। হাইছু কা-না। ছুম্মার দিনী-।
আল্লাহ! আমি আপনার ইলমের মাধ্যমে কল্যান কামনা করছি। আপনার কুদরতের মাধ্যমে ‘শক্তি’ কামনা করছি। আপনার মহা অনুগ্রহ প্রার্থনা করছি। কারণ আপনিই ক্ষমতাবান, আমার কোনও ক্ষমতা নেই। আপনি সব জানেন, আমি জানি না। আপনি গাইবের মহাজ্ঞানী।
ইয়া আল্লাহ! আপনার ইলমে (জানায়) যদি উক্ত বিষয়টা আমার দ্বীন-দুনিয়া-জীবিকা-পরিণতির জন্যে কল্যাণকর হয়, তাহলে সেটা আমার জন্যে নির্ধারণ করে দিন। সহজ করে দিন। তাতে বরকত দান করুন। আর যদি বিষয়টা আমার জন্যে সার্বিকভাবে অকল্যাণকর হয়, বিষয়টা আমার কাছ থেকে সরিয়ে দিন। আমাকেও বিষয়টা থেকে সরিয়ে নিন। আমি যে অবস্থাতেই থাকি, আমার জন্যে কল্যাণের ফয়সালা করুন। আমাকে খুশি করে দিন।
৪) মনে হতে পারে, বড় কোনও বিপদ বা গুরুত্বপূর্ণ কোনও কাজ হলে, ইস্তিখারার নামায পড়তে হবে। এই চিন্তা সঠিক নয়। পাশাপাশি ইস্তিখারার পর, ঘুমের মধ্যে কোনও ইঙ্গিতপূর্ণ স্বপ্ন দেখাও জরুরী নয়। হাদীসের ভাষ্যমতে, ইস্তিখারাকারী নামায আদায় করে, দু‘আটা পড়ে, কাজে নেমে পড়বে। যদি দেখে কাজটা সহজেই করা যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে। আর পরিস্থিতি ভিন্ন হলে, নানা প্রতিবন্ধকতা আসতে থাকলে, ক্ষান্ত দিবে।
৫) দোয়াটি সালামের আগে নামাযের মধ্যেও পড়া যাবে। সালাম ফেরানোর পরও পড়া যাবে। ব্যস্ততা থাকলে নামায পড়া ছাড়া, শুধু দোয়াটি পড়েও কাজ শুরু করা যাবে। মহিলাদের বিশেষ সময়ে নামায পড়া অসম্ভব, অথবা সফরের হালতে বা নামায পড়া যায় না, এমন হালতে থাকলে পুরুষও শুধু দোয়াটি পড়ে কাজ শুরু করতে পারবে।
৬) সুন্নাত তরীকায় ইস্তিখারা করার ভাবনাই তো কেমন শিহরন জাগানো। ভাবতেই কেমন গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে, আমি এখন যা করতে যাচ্ছি, সরাসরি আল্লাহ সাহায্যকারী হিশেবে আছেন। সঠিক সিদ্ধান্তটা সরাসরি আল্লাহর পক্ষ থেকেই আসছে। আর এত সহজ একটা ‘আমল’ খোদ নবীজি শিখিয়ে দিয়ে গেছেন! আর কিছু লাগে?
৭) সলাতুল ইস্তেখারা পড়ার মানে, আমি চূড়ান্ত পর্যায়ের অসহায় হয়ে আল্লাহর দ্বারস্থ হয়েছি। আমি সম্পূর্ণ সহায়-সম্বলহীন হয়ে আল্লাহর চৌকাঠ মাড়াচ্ছি। ইস্তেখারার পাশাপাশি অভিজ্ঞজনের কাছে ‘ইস্তেশারাহ’-এর আমলও করতে পারি। ইস্তেশারা মানে পরামর্শ চাওয়া। দুটি সুন্নত একসাথে আদায় হল।
৮) বিপদে বিচলিত কেন মুমিন? আমার আল্লাহ আছেন। আমার কাজ শুধু তার কাছে নিজেকে পরিপূর্ণ সোপর্দ করে দেয়া। আমার কোনও দোষ থাকলে, খাসদিলে তাওবা করে নেব। ছোট থেকে ছোট বিষয়েও ইস্তেখারা করব। সাথে থাকবে ইস্তেশারা।
৯) সময়ের স্বল্পতা বা অন্য কোনও সমস্যার কারণে বড় দোয়াটি পড়তে না পারলে, আরেকটি দোয়া পড়া যেতে পারে। আবু বকর সিদ্দীক রা. বর্ণনা করেছেন,
اللَّهمَّ خِر لي واختَر لي
আল্লাহুম্মা খির লী, ওয়াখতার লী। ইয়া আল্লাহ, আমার জন্য খাইর-কল্যানের ফয়সালা করুন। আমার জন্য কল্যাণকর বিষয় বাছাই করুন (তিরমিজী ৩৫১৬। আল্লামা আলবানী-যয়ীফ)।
১০) অত্যন্ত উপকারী সুন্নতটি আমরা অভ্যেসে পরিণত করতে পারি। রাব্বে কারীম তাওফীক দান করুন।
আমীন ইয়া রাব্বাল আলামিন