আমাদের ধারণা মোহরের পরিমাণ যত কম হবে শরীয়তের দৃষ্টিতে ততই উত্তম ও প্রশংসনীয় হবে। বরের পক্ষ চায় মোহর কম দিতে আর কনের পক্ষ চায় মোহর বেশি নিতে। উভয় পক্ষের এমন ধারণা যে, মোহর সেটা, মজলিসের সৌন্দর্য। দিতে হবে না। কেউ কি কখনো দিয়েছে? অথচ, একথা গুলো সম্পূর্ণ শরিয়ত বিরোধী। কারণ, মোহর আদায় করা ফরজ। অনাদায়ে বর গুণাহগার হবে। ঋণ কাঁদে নিয়ে কবরে যাবে। কিয়ামতের দিন ঋণ দাতা ও ঋণগ্রহীতার যে অবস্থা হবে, মোহর অনাদায়ী বর ও কনের একই অবস্থা হবে। মোহর সম্পর্কে এভাবে আমাদের সমাজে অনেক ভুল ধারণা আছে, যা দূর করা অতি প্রয়োজন।
মোহর মূলত একটি সম্মানী (ঐড়হড়ৎধৎরঁস) যা স্বামী তার স্ত্রীকে দিয়ে থাকে, যার মূল উদ্দেশ্যই হল নারীকে সম্মান ও মর্যাদা দেওয়া। এটা নারীর মূল্য নয় যে, তা পরিশোধ করলেই মনে করা যাবে, নারী নিজেকে স্বামীর হাতে বিক্রি করে দিয়েছে। তেমনি এ শুধু কথার কথাও নয়, যা শুধু ধার্য করা হয়, পরিশোধ করার বাধ্যবাধকতা থাকে নয়; বরং শরীয়তের উদ্দেশ্য হল যখন কোনো পুরুষ স্ত্রীকে ঘরে আনবে তখন তাকে মর্যাদার সাথে আনবে এবং এমন কিছু উপহার দিবে, যা তাকে সম্মানিত করে। এজন্য শরীয়তের তাকাযা বা চাহিদা হচ্ছে মোহর এত অল্পও নির্ধারণ না করা, যাতে মর্যাদার কোনো ইঙ্গিত থাকে না। আবার এত অধিকও নির্ধারণ না করা, যা পরিশোধ করা স্বামীর পক্ষে সম্ভব হয় না। অন্যথায় হয়তো মোহর আদায় না করেই দুনিয়া থেকে বিদায় নিবে, নতুবা জীবনের অন্তিম মুহূর্তে স্ত্রীর কাছে মাফ চাইতে বাধ্য হবে।
শরীয়তের দৃষ্টিতে প্রত্যেক নারীর আসল হক ‘মোহরে মিছল’। ঐ নারীর বংশে তার মতো অন্যান্য নারীদের সাধারণত যে মোহর নির্ধারণ করা হয়েছে সেটা তার মোহরে মিছ্ল। যদি তার নিজের বংশে তার মতো আর কোনো নারী না থাকে, তাহলে অন্য বংশে তার সমপর্যায়ের নারীদের যে মোহর সাধারণত নির্ধারণ করা হয় সেটাই তার মোহরে মিছল। শরীয়তের দৃষ্টিতে স্ত্রী মূলত মোহরে মিছ্লের হকদার। এ কারণেই যদি মোহরের আলোচনা ছাড়া বিয়ে হয় কিংবা পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে মোহর নির্ধারিত না হয় তাহলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে মোহরে মিছল অবধারিত হয়ে যায় এবং এক্ষেত্রে মোহরে মিছল পরিশোধ করা স্বামীর জন্য জরুরি হয়ে পড়ে। তবে স্ত্রী নিজেই যদি সন্তুষ্টচিত্তে মোহরে মিছল হতে কম নিতে রাজি হয় অথবা স্বামী খুশি মনে মোহরে মিছল থেকে অধিক পরিমাণ মোহর নির্ধারণ করে তবে শরীয়তে এর অনুমতি আছে। অর্থাৎ উভয় পক্ষের সম্মতিতে মোহরে মিছল হতে কম-বেশি করেও মোহর নির্ধারণ করা যায়। আর এক্ষেত্রেও এমন কোনো পরিমাণ নির্ধারিত নেই, যার বেশি মোহর ধার্য করা যায় না। তবে সর্বনিম্ন পরিমাণটি শরীয়তের নির্ধারিত। হানাফী মাযহাব মতে তা হচ্ছে দশ দিরহাম। দশ দিরহামের অর্থ, প্রায় দুই তোলা সাড়ে সাত মাশা রূপা।
সর্বনিম্ন পরিমাণ মোহর নির্ধারিত থাকার অর্থ এই নয় যে, এত সামান্য পরিমাণ মোহর নির্ধারণ করা শরীয়তে প্রশংসনীয়; বরং উদ্দেশ্য হল, তার চেয়েও কম মোহরে স্ত্রী সম্মত হলেও শরীয়ত সম্মত নয়। কারণ এর দ্বারা মোহরের মূল উদ্দেশ্য পূরণ হয় না। তাছাড়া মোহরের এই সর্বনিম্ন পরিমাণও রাখা হয়েছে আর্থিকভাবে দুর্বল লোকদের কথা বিবেচনা করে, যাতে তারাও নারীর সম্মতির শর্তে এই পরিমাণ অর্থ দ্বারা বিবাহ করতে পারে। তাই একথা মনে করা মোটেও সঠিক নয় যে, শরীয়ত দু’ শ টাকা মোহর ধার্য করতে উৎসাহিত করেছে এবং এ অর্থে তা মোহরে শরয়ী। যারা এখন বত্রিশ টাকাকে মোহর নির্ধারণ করে সেটাকে শরীয়তসম্মত মোহর আখ্যা দিয়েছে তারা দুটি ভুল করেছে : প্রথম ভুল এই যে, দশ দিরহামের মূল্য কোনো যুগে হয়তো বত্রিশ টাকা ছিল, তারা সেটাকে সব সময়ের জন্য ধরে নিয়েছে। দ্বিতীয় ভুল হল শরীয়ত মোহরের যে সর্বনিম্ন পরিমাণ নির্ধারণ করেছে, তার অর্থ তারা এই করেছে যে, শরীয়তের দৃষ্টিতে এর চেয়ে অধিক মোহর নির্ধারণ করা অনুচিত। তাদের এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল।
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ কন্যা হযরত ফাতেমা রা.-এর মোহর পাঁচ শত দিরহাম নির্ধারণ করেছিলেন, যা প্রায় ১৩১ তোলা তিন মাশা রূপার সমতুল্য। তেমনি তাঁর স্ত্রীগণের মধ্যে অনেকের মোহর এর কাছাকাছি নির্ধারণ করেছিলেন, যা মধ্যম পর্যায়ের হওয়ার কারণে একটি গ্রহণযোগ্য ও উপযুক্ত পরিমাণ।
অনেক লোক মোহরে ফাতেমিকে শরীয়তী মোহর বলে থাকেন। তাদের উদ্দেশ্য যদি এই হয় যে, শরীয়তের দৃষ্টিতে এর চেয়ে বেশি পরিমাণের মোহর নির্ধারণ করা অপছন্দনীয় তাহলে এই ধারণাও সঠিক নয়। তবে এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, উভয় পক্ষ যদি পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে মোহরে ফাতেমি নির্ধারণ করে এবং মনে করে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নির্ধারণ করা পরিমাণটি বরকতপূর্ণ ও ভারসাম্যপূর্ণ বিধায় তা গ্রহণ করা ভালো এবং এর মাধ্যমে সুন্নতের ছওয়াব লাভের প্রত্যাশা রয়েছে তাহলে এই আবেগ-অনুভূতি নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। কিন্তু এই ধারণা ঠিক নয় যে, মোহরে ফাতেমি এই অর্থে শরীয়তী মোহর যে, তার চেয়ে কম-বেশি করা শরীয়তের দৃষ্টিতে অপছন্দনীয়।
মোহর এই পরিমাণ হতে হবে, যা দ্বারা স্ত্রীকে সম্মানিত করা হয় এবং যা স্বামীর সামর্থ্যের চেয়ে বেশি না হয়। যেসব বুযুর্গ বড় অংকের মোহর নির্ধারণ করতে নিষেধ করেছেন তাদের উদ্দেশ্যও এই যে, সামর্থ্যের চেয়ে অধিক মোহর নির্ধারণ করা হলে তা একটি কাগুজে লেনদেনে পর্যবসিত হবে, বাস্তবে কখনো তা পরিশোধ করা হবে না। ফলে স্বামীর ঘাড়ে মোহর আদায় না করার গুনাহ থেকে যাবে। দ্বিতীয়ত অনেক সময় বড় অংকের মোহর নির্ধারণের পিছনে লোক দেখানোর মানসিকতাও কার্যকর থাকে। অনেকে শুধু নিজেদের প্রভাব-প্রতিপত্তি দেখানোর জন্যও অস্বাভাবিক বড় অংকের মোহর নির্ধারণ করে। বলাবাহুল্য, এই দু’টো বিষয়ই ইসলামের স্বভাব-প্রকৃতির সম্পূর্ণ বিরোধী। এ জন্যই অনেক বুযুর্গ অস্বাভাবিক বড় অংকের মোহর নির্ধারণ করতে নিষেধ করেছেন। তবে এ প্রসঙ্গে হযরত ওমর রা.-এর একটি ঘটনা স্মরণ রাখার মতো। হযরত ওমর রা. তাঁর খিলাফতের যুগে একবার ভাষণ দিলেন যে, কেউ যেন বিয়ে-শাদিতে বড় অংকের মোহর নির্ধারণ না করে। তখন এক মহিলা আপত্তি করে বললেন, কুরআন মজীদের এক জায়গায় তো এক কিনতার (সোনা-রূপার স্ত্তপ) মোহর দেওয়ার কথাও আছে, যা প্রমাণ করে যে, সোনা-রূপার স্ত্তপও মোহর হতে পারে। তাহলে বড় অংকের মোহর নির্ধারণে বাধা দিচ্ছেন কেন? হযরত ওমর রা. তাঁর কথা শুনে বললেন, বাস্তবেই তাঁর দলীল সঠিক। অধিক পরিমাণ মোহর নির্ধারণ করা থেকে সম্পূর্ণরূপে নিষেধ করা ঠিক নয়। এর অর্থ হল যদি লোক দেখানোর উদ্দেশ্য না থাকে এবং মোহর আদায় করার ইচ্ছা ও সামর্থ্যও থাকে তবে অধিক পরিমাণ মোহর নির্ধারণ করা জায়েয। আর যদি কোনো একটি শর্তও অনুপস্থিত থাকে তবে সেক্ষেত্রে অত্যধিক মোহর নির্ধারণ করা জায়েয নয়।
প্রসঙ্গত আরো একটি বিষয় পরিষ্কার হওয়া প্রয়োজন। আমাদের মধ্যে দুই ধরনের মোহরের প্রচলন রয়েছে। এক. مهر معجل (মোহরে মু‘আজ্জাল) বা নগদ মোহর। দুই.مهر مؤجل (মোহরে মুয়াজ্জাল) বা বাকি মোহর। এ শব্দগুলো যেহেতু বিয়ের মজলিস ছাড়া সচরাচর শোনা যায় না তাই অনেকে এ শব্দ দুটির অর্থ বুঝে না। শরীয়তের দৃষ্টিতে মোহরে মু‘আজ্জাল হল সেই মোহর, যা বিয়ে সম্পন্ন হওয়ামাত্র নগদ আদায় করা অপরিহার্য হয়ে যায়। হয়তো সে বিয়ের সময়ই তা পরিশোধ করে দিবে অথবা বিয়ের পর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পরিশোধ করবে। এক্ষেত্রে স্ত্রীর তা দাবি করার অধিকার আছে। যেহেতু আমাদের সমাজে নারীরা সাধারণত মোহর দাবি করে না তাই এরূপ মনে করা উচিত হবে না যে, সেটা পরিশোধ করা আমাদের জন্য জরুরি নয়; বরং কর্তব্য হল স্ত্রীর চাওয়ার অপেক্ষা না করে যত দ্রুত সম্ভব এই ফরয দায়িত্ব হতে মুক্ত হওয়া।
মোহরে মুয়াজ্জাল বলা হয় সেই মোহরকে, যা পরিশোধের জন্য উভয় পক্ষ কোনো তারিখ নির্ধারণ করে। ঐ তারিখ আসার আগে মোহর আদায় করা স্বামীর জন্য আবশ্যকীয় নয়। স্ত্রীও সেই তারিখের আগে এই মোহর দাবি করতে পারবে না। সুতরাং মোহর মুয়াজ্জাল হওয়ার অর্থ হচ্ছে, বিয়ের দিনই তা পরিশোধের তারিখ নির্ধারণ করা হবে, কিন্তু আমাদের সমাজে সাধারণত কোনো দিন-তারিখ নির্ধারণ না করে শুধু এটুকু বলে দেওয়া হয় যে, এই পরিমাণ মোহরে মুয়াজ্জাল (বাকি মোহর)। আর সামাজিক প্রচলন অনুযায়ী তার অর্থ দাঁড়ায়, তা পরিশোধ করা হবে স্ত্রীকে তালাক দেওয়া হলে কিংবা স্বামী-স্ত্রী কারো মৃত্যু হলে। এটিও একটি ভুল প্রচলন।
আরেকটি বিষয় হল, স্বামীর পক্ষ হতে নববধুকে যে গয়নাগাটি দেওয়া হয় মোহরের সাথে তার সরাসরি সম্পর্ক নেই। আমাদের সামাজিক প্রচলন মতে স্ত্রী এই অলংকারের মালিক হয় না; বরং সেগুলো তাকে ব্যবহারের জন্য দেওয়া হয়। ফলে স্ত্রী সেই অলংকার স্বামীর অনুমতি ছাড়া বিক্রি করতে পারে না এবং কাউকে উপহারও দিতে পারে না। আর এ কারণেই-আল্লাহ না করুন-তালাকের ঘটনা ঘটলে স্বামী তা ফিরিয়ে নেয়। এ ধরনের অলংকার দ্বারা মোহর আদায় হয় না। তবে স্বামী যদি স্ত্রীকে স্পষ্টভাবে বলে যে, আমি এই অলংকার মোহরস্বরূপ তোমাকে দিয়েছি এবং তুমি এর মালিক তাহলে সেই অলংকার মোহর হিসেবে গণ্য হবে। সেক্ষেত্রে ঐ অলংকারের উপর স্ত্রীর পূর্ণ অধিকার থাকবে এবং কোনো অবস্থাতেই তা স্ত্রীর নিকট থেকে ফেরত নেওয়া যাবে না।
যাই হোক, মোহর নির্ধারণের বিষয়টি নিছক কথার কথা বা ঐচ্ছিক কোনো আচার পালনের বিষয় নয়; বরং তা একটি ফরয বিধান ও গুরুত্বপূর্ণ দ্বীনী দায়িত্ব, যা পূর্ণ মনোযোগ ও বিচার-বিবেচনার দাবি রাখে। এটি একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ লেনদেন। অতএব এর যাবতীয় দিক শরীয়ত অনুযায়ী ও পরিষ্কারভাবে হওয়া উচিত এবং সে হিসেবেই তা পরিশোধের চিন্তা-ভাবনা করা উচিত। এটি বড়ই অন্যায় কথা যে, সারা জীবন উদাসীন থেকে মৃত্যুশয্যায় স্ত্রীর নিকট মাফ চাওয়া হয়, যখন পরিস্থিতির চাপে স্ত্রীরও মাফ করে দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না।
কুরআন মাজিদে মোহরের বিধান
ইসলামের যে বিধানগুলো স্বয়ং আল্লাহ তাআলা বারবার বিভিন্ন আয়াতে বয়ান করেছেন তা পালনের অপরিহার্যতা বলার অপেক্ষা রাখে না। মানুষের অবহেলা ও অমনোযোগিতার কারণে সেসব বিধান সমাজের চোখে গুরুত্বহীন হয়ে গেলেও আল্লাহর কাছে তা গুরুত্বহীন নয়।
ঐসব বিধানের অন্যতম হচ্ছে নারীর মোহর। কত প্রসঙ্গে কতভাবে যে আহকামুল হাকিমীন আল্লাহ এই বিধানটি বয়ান করেছেন! বিবাহ-বন্ধনের প্রসঙ্গে, বিবাহ-বিচ্ছেদের প্রসেঙ্গ, ঈমানদার ব্যক্তি ও সমাজের বৈশিষ্ট্য প্রসঙ্গে, জাহেলী-সমাজের বর্বরতা রোধ প্রসঙ্গে মোটকথা অনেকভাবে অনেক জায়গায় মোহরের বিধান বর্ণনা করেছেন। তাই কুরআন মজীদে যেমন আছে এর আইন ও বিধানগত দিক তেমনি আছে নৈতিক ও মানবিক দিক, যা মুমিনের চিন্তা ও মস্তিষ্কের পাশাপাশি আলোড়িত করে তার কলব ও হৃদয়কেও। এই সকল কিছুর সাথে মুমিন নর-নারীকে স্মরণ করানো হয়েছে আল্লাহর আদালত ও বিচার-দিবসের অমোঘ সত্যের কথা। তাই একমাত্র কুরআনই পারে নারী-পুরুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে এবং সঠিক পথের দিশা দিতে যদি তারা সমর্পিত হয় কুরআনের বিধান ও শিক্ষার প্রতি।
এই নিবন্ধে মোহর বিষয়ক আয়াতগুলো সংক্ষিপ্ত আলোচনাসহ তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। যেন সবার আগে আমরা মুমিনরা কুরআনের আলোয় আলোকিত হতে পারি।
বিয়েতে মোহর অপরিহার্য বিষয়
واحل لكما ما وراء ذلكم ان تبتغوا باموالكم محصنين غير مسافحين فما استمتعتم به منهن فاتوهن اجورهن فريضة ولا جناح عليكم فيما تراضيتم به من بعد الفريضة ان الله كان عليما حكيما
উল্লিখিত নারীরা ছাড়া অন্যদেরকে তোমাদের জন্য বৈধ করা হয়েছে, যে স্বীয় সম্পদ দ্বারা প্রয়াসী হবে তাদের সাথে বিবাহবন্ধনে, ব্যভিচারে নয়। অতএব তাদের নিকট থেকে তোমরা যে আনন্দ উপভোগ করেছ (সে কারণে) তাদের ধার্যকৃত মোহর তাদেরকে প্রদান করবে। আর মোহর নির্ধারিত থাকার পরও কোনো বিষয়ে পরস্পর সম্মত হলে তাতে তোমাদের কোনো অপরাধ হবে না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।-সূরা নিসা : ২৪
এই আয়াতে বিয়ে-শাদি সম্পর্কে কিছু মৌলিক বিধান দেওয়া হয়েছে, যার বিস্তারিত ব্যাখ্যা রয়েছে হাদীস শরীফে। এই আয়াত থেকে যে বিধানগুলি পাওয়া যায় তা হচ্ছে :
১. ‘মুহাররামাত’ (যাদের সাথে বিবাহ হারাম করা হয়েছে) ছাড়া অন্যদের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া বৈধ। কুরআন মজীদে ও হাদীস শরীফে মুহাররামাতের বিবরণ ও আনুষঙ্গিক বিধানাবলি দেওয়া হয়েছে।
২. মোহর ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ ফরয এবং বিয়ের অপরিহার্য অনুষঙ্গ। মোহর ছাড়া বিয়ে হয় না। আকদের সময় উল্লেখ না করলেও কিংবা না দেওয়ার শর্ত করলেও মোহর বাতিল হয় না।
৩. স্বামীর কর্তব্য যথাযথভাবে মোহর পরিশোধ করা।
৪. বিয়ের পর সহবাস হলে (কিংবা একান্তে সাক্ষাত হলে, যাকে পরিভাষায় ‘খালওয়াতে সহীহা’ বলে), পূর্ণ মোহর আদায় করা অপরিহার্য। সুতরাং আকদের সময় মোহর ধার্য করা হলে ধার্যকৃত পূর্ণ মোহর আর ধার্য না হয়ে থাকলে মোহরে মিছ্ল দিতে হয়।
৫. ধার্যকৃত মোহর থেকে স্ত্রী যেমন কিছু ছেড়ে দিতে পারে তেমনি স্বামীও কিছু বেশি দিতে পারে। স্বেচ্ছায় স্বাগ্রহে হলে এতে কোনো দোষ নেই।
৬. মোহর এমন কিছু হতে হবে, যা শরীয়তের দৃষ্টিতে ‘মাল’ (সম্পদ) বলে গণ্য।
মোহরের সর্বনিম্ন পরিমাণ কুরআন মজীদে স্পষ্টভাবে বলা হয়নি। হাদীস, আছার ও শরীয়তের অন্যান্য দলীলে তা বলা হয়েছে। ফিকহে হানাফী অনুসারে সর্বনিম্ন মোহর দশ দিরহাম।
৭. বিয়েতে ইজাব-কবুল ও সাক্ষী অপরিহার্য। এই শর্তগুলোর বিস্তারিত ব্যাখ্যা হাদীস শরীফে রয়েছে।
(দেখুন : আহকামুল কুরআন, জাসসাস ২/১৪০-১৪৬; আহকামুল কুরআন, ইবনুল আরাবী ১/৩৮৪-৩৯০; তাফসীরে উছমানী পৃ. ১০৫
উপরোক্ত বিধানগুলো ছাড়াও একজন মুমিন এই আয়াত থেকে আরো কিছু শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেন।
যেমন : ১. মোহর যদিও একটি মধুর লেনদেন এবং ঐভাবেই তা আদায় করা উচিত, তবে তা নিছক উপহার নয় যে, ইচ্ছা হলে দেওয়া যায়, ইচ্ছে হলে বিরত থাকা যায়; বরং তা হল স্ত্রীর প্রাপ্য অধিকার। স্ত্রী যেমন প্রীতি ও ভালবাসার সাথে নিজেকে অর্পণ করেছে, স্বামীরও কর্তব্য সম্মান ও মর্যাদার সাথে তার মোহর আদায় করা।
২. স্ত্রীর মোহর ফাঁকি দেওয়া অতি হীন কাজ। কারণ এর অর্থ দাঁড়ায়, ভোগ করতে রাজি, কিন্তু বিনিময় দিতে রাজি নয়। যে স্বামীর মনে স্ত্রীর মোহর আদায়ের ইচ্ছাটুকুও নেই হাদীস শরীফে তাকে বলা হয়েছে ‘ব্যাভিচারী’। (দেখুন : মাজমাউয যাওয়াইদ ৪/৫২২-৫২৩)
৩. অনেক বড় অংকের মোহর ধার্য করা যেমন শরীয়তে কাম্য নয় তেমনি তা একেবারে তুচ্ছ ও সামান্য হওয়াও উচিত নয়। মোহরের পরিমাণ এমন হওয়া চাই, যা সাধারণত আগ্রহের বিষয় হয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাহ ও সাহাবায়ে কেরামের সাধারণ রীতি এক্ষেত্রে উত্তম আদর্শ। এ প্রসঙ্গে কয়েকটি হাদীস :
আবু সালামা ইবনে আবদুর রহমান বলেন, আমি (উম্মুল মুমিনীন) আয়েশা রা.কে জিজ্ঞাসা করলাম যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কী পরিমাণ মোহর দিয়েছেন? তিনি বললেন, ‘নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর স্ত্রীদেরকে সাড়ে বারো উকিয়া অর্থাৎ পাঁচ শ’ দিরহাম মোহর দিয়েছেন।’-সহীহ মুসলিম, হাদীস : ১৪২৬; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ২১০৫; সুনানে নাসায়ী ৬/১১৬, ১১৭
উম্মুল মুমিনীনদের মাঝে উম্মে হাবীবা রা.-এর মোহর বেশি ছিল। তাঁর মোহর ছিল চার হাজার দিরহাম। হাবশার বাদশাহ নাজাশী তাঁকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে বিয়ে দিয়েছিলেন এবং মোহরও তিনিই পরিশোধ করেছিলেন।-সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ২১০৭; সুনানে নাসায়ী ৬/১১৯
আবু হুরায়রা রা. বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যুগে আমাদের মোহর ছিল দশ উকিয়া (চার শ দিরহাম)।-সুনানে নাসায়ী ৬
খুশি মনে মোহর আদায় করো
واتوا النساء صدقاتهن نحلة فان طبن لكم عن شيئ منه نفسا فكلوا هنيئا مرئيا
এবং তোমরা নারীদেরকে দাও তাদের মোহর খুশিমনে। এরপর তারা যদি স্বেচ্ছায় স্বাগ্রহে ছেড়ে দেয় কিছু অংশ তোমাদের জন্য তাহলে তা স্বচ্ছন্দে ভোগ কর।-সূরা নিসা : ৪
এই আয়াতের প্রধান কয়েকটি শিক্ষা ও বিধান এই :
১. মোহর আদায় করা ফরয। স্বয়ং আল্লাহ তাআলা মোহর আদায়ের আদেশ করেছেন।
২. মোহর সম্পূর্ণরূপে নারীর প্রাপ্য। তার স্বতঃস্ফূর্ত সম্মতি ছাড়া অন্য কারো তাতে হস্তক্ষেপের সুযোগ নেই। সুতরাং স্বামী যেমন স্ত্রীকে মোহর থেকে বঞ্চিত করতে, কিংবা পরিশোধ করার পর ফেরত নিতে পারে না তেমনি পিতা-মাতা, ভাইবোন বা অন্য কেউ নিজ কন্যার, বোনের বা আত্মীয়ার মোহর তার স্বতঃস্ফূর্ত সম্মতি ছাড়া নিতে পারে না। নিলে তা হবে কুরআনের ভাষায় ‘আক্ল বিল বাতিল’ তথা অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করা।
৩. মুমিনের কর্তব্য খুশিমনে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে স্ত্রীর মোহর আদায় করা। কারো অনুরোধ-উপরোধ বা জোর-জবরদস্তির অপেক্ষায় থাকা কুরআনী শিক্ষার পরিপন্থী ও অতি নিন্দনীয় প্রবণতা।
৪. স্ত্রী যদি স্বতঃস্ফূর্তভাবে মোহরের কিছু অংশ ছেড়ে দেয় কিংবা গ্রহণ করার পর স্বামীকে উপহার দেয় তাহলে স্বামী তা স্বচ্ছন্দে ভোগ করতে পারবে।
৫. পূর্ণ মোহর ছেড়ে দেওয়ার বা পূর্ণ মোহর স্বামীকে উপহার দেওয়ারও অধিকার স্ত্রীর রয়েছে, তবে সাধারণ অবস্থায় পূর্ণ মোহর না দিয়ে কিছু অংশ দেওয়াই ভালো।
৬. স্বামী যদি চাপ দিয়ে বা কৌশলে পূর্ণ মোহর বা কিছু অংশ মাফ করিয়ে নেয় তাহলে আল্লাহর বিচারে তা মাফ হবে না।
(দেখুন : আহকামুল কুরআন, জাসসাস ২/৫৭-৫৮; তাফসীরে ইবনে কাছীর ১/৪৪২; বয়ানুল কুরআন ২/৯৩; তাফসীরে উছমানী, পৃ. ১০০)
যদি মোহর আদায় কর!
يا ايها الذين آمنوا اذا جاءكم المؤمنات مهاجرات فامتحنوهن الله اعلم بايمانهن فان علمتموهن مؤمنت فلا ترجعوهن الى الكفار لا هن حل لهم ولا هم يحلون لهن واتوهن ما انفقوا ولا جناح عليكم ان تنكحوهن اذا آتيتموهن اجورهن
হে মুমিনগণ! ঈমানদার নারীরা যখন তোমাদের নিকট হিজরত করে আসে তখন তাদেরকে পরীক্ষা করো। আর আল্লাহই সম্যক অবগত তাদের ঈমান সম্পর্কে। যদি তোমাদের মনে হয় যে, তারা মুমিন তাহলে কাফিরদের নিকট তাদেরকে ফেরত পাঠিয়ো না। না এই (মুমিন) নারীরা বৈধ ওদের জন্য আর না ওরা বৈধ এদের জন্য। (তবে) কাফিররা যা খরচ করেছে তা তাদেরকে ফিরিয়ে দিও। এই নারীদের বিয়ে করলে তোমাদের কোনো অপরাধ হবে না যদি তোমরা আদায় কর তাদের মোহরানা। -সূরা মুমতাহিনা (৬০) : ১০
এই আয়াত হুদায়বিয়ার সন্ধির প্রেক্ষাপটে নাযিল হয়েছে এবং সন্ধিকালীন পরিস্থিতির কিছু বিধানও তাতে বর্ণিত হয়েছে। বিস্তারিত আলোচনা তাফসীরের কিতাবে দেখা যেতে পারে। এখানে মোহর সংক্রান্ত শিক্ষা ও বিধানগুলো আলোচনা করছি।
১. এই আয়াতেও মোহরকে ‘আজ্র’ বা বিনিময় বলা হয়েছে। দ্বিতীয়ত নারীর সাথে সম্বন্ধ করে বলা হয়েছে ‘তাদের বিনিময়’। অন্যান্য আয়াতেও এ দুটি বিষয় পাওয়া যায়। এই শব্দ ও উপস্থাপনা থেকেও বোঝা যায়, মোহর নারীর প্রাপ্য অধিকার। সুতরাং তা পরিশোধ করা অপরিহার্য। এই আয়াতে তৃতীয় যে বিষয়টি আছে তা হল বিবাহবন্ধনকে মোহর আদায়ের সাথে শর্তযুক্ত করে বলা হয়েছে, ‘এই নারীদের বিয়ে করলে তোমাদের অপরাধ হবে না যদি তোমরা আদায় কর তাদের মোহরানা।’ এটিও মোহরের অপরিহার্যতা প্রমাণ করে।
এই আয়াতে বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বর্ণনা করার এক তাৎপর্য এই হতে পারে যে, আগের আয়াতে সন্ধিকালীন পরিস্থিতির কারণে বিধান দেওয়া হয়েছিল, কোনো ঈমানদার নারী যদি হিজরত করে মুসলমানদের কাছে চলে আসে তাহলে কাফির স্বামীর প্রদত্ত মোহর ফেরত দিতে হবে। কারণ একদিকে মুমিন নারীকে কাফির পুরুষের কাছে ফেরত পাঠানোও সম্ভব নয়, অন্যদিকে সন্ধিচুক্তির কারণে প্রতিপক্ষকে স্ত্রী ও সম্পদ দু’ দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত করাও সঙ্গত নয়। সুতরাং তার প্রদত্ত মোহর ফেরৎ দিতে বলা হয়েছে।
যে পুরুষ ঐ নারীকে নতুবা সে তা পরিশোধ করবে, বিয়ে না হলে বাইতুল মাল থেকে পরিশোধ করা হবে। এই বিধানের কারণে মনে হতে পারে যে, কাফির স্বামীকে যেহেতু মোহর ফেরৎ দেওয়া হয়েছে তাই নতুন বিয়েতে মোহর লাগবে না। এই ধারণা যাতে না হয় সেজন্য তাকীদের সাথে বলে দেওয়া হয়েছে যে, এই অবস্থাতেও স্ত্রীকে মোহর দিতে হবে। এটি নতুন বিবাহ, কাজেই নতুন মোহর অপরিহার্য।
(দেখুন : তাফসীরে ইবনে কাসীর ৪/৫৪৭; তাফসীরে উছমানী, পৃ. ৭৩০; বয়ানুল কুরআন ১১/১৩৪; মাআরিফুল কুরআন, মুফতী মুহাম্মাদ শফী রাহ. ৮/৪১৪)
আয়াত নাযিলের প্রেক্ষাপট থেকে এই শিক্ষা গ্রহণ করা যায় যে, যেখানে কিছুটা যুক্তিসঙ্গত কারণে মোহর মওকুফের ধারণা হতে পারত সেখানেও যদি তা গ্রহণযোগ্য না হয় তাহলে ঐসকল চিন্তা ও ধারণা কীভাবে গ্রহণযোগ্য হবে যেগুলো নিছক শয়তানের ওয়াসওয়াসা? যেমন, কোনো বিপন্ন ও অসহায় নারীকে বিয়ে করার পর এই অজুহাত দেখানো যে, একে বিয়ে করেই তো মহা উপকার করেছি, আবার মোহর দিতে হবে কেন? (নাউযুবিল্লাহ)
প্রসঙ্গত বলা যায় যে, উপরের আয়াতটি ঐ সকল নারীদের সম্পর্কেই নাযিল হয়েছে, যাঁরা তাদের স্বামী- সন্তান, মাতৃভূমি ও আত্মীয়-স্বজন ছেড়ে দারুল ইসলামে এসেছেন। আর এ ধরনের নারী তো বিপন্ন ও অসহায়ই হয়ে থাকেন।
তেমনি স্ত্রীর ভরণ-পোষণকে অজুহাত বানিয়ে মনে করা যে, তাঁর সব খরচই তো বহন করছি, কাজেই আলাদা করে মোহর না দিলে কী হয়? কিংবা তার সব খরচই যখন এখান থেকে হচ্ছে তো মোহরের তার কী প্রয়োজন?!
এটাও শয়তানের ওয়াসওয়াসা। মোহর ও ভরণ-পোষণ দু’টি আলাদা দায়িত্ব। সুতরাং দুটোই স্বামীকে বহন করতে হবে। একটির অজুহাতে অন্যটি পালন না করার সুযোগ নেই। আর স্ত্রী তার মোহর দিয়ে কী করবে-সেটা তার ইচ্ছা। যে কোনো জায়েয খাতে সে তা ব্যয় করতে পারে। স্বামীর কর্তব্য হচ্ছে মোহর পরিশোধ করা। এরপর স্ত্রী যদি অনুগত ও বুদ্ধিমতি হয় তাহলে নিশ্চয়ই স্বামীর সাথে পরামর্শ করেই তা খরচ করবে।
কারো মনে হতে পারে, জীবনে তো কত কিছুই স্ত্রীকে দিয়েছি। সবকিছু তো আমার উপর অপরিহার্যও ছিল না। সুতরাং বিয়ের সময় সামান্য যে কটি টাকা ধার্য করা হয়েছিল তা নিয়ে এত চুলচেরা হিসাব-নিকাশের কী প্রয়োজন? এই ধারণাও ঠিক নয়। মোহর আদায়ের নিয়ত ছাড়া নিছক উপহার হিসেবে যা কিছু দেওয়া হয় তার দ্বারা মোহর আদায় হয় না। তেমনি টাকা-পয়সা ও সোনা-রূপা ছাড়া অন্যান্য বস্ত্ত যেমন কাপড়-চোপড়, জমিজমা ইত্যাদি যদি আকদের সময় মোহর সাব্যস্ত করা না হয় তাহলে শুধু মনে মনে মোহরের নিয়ত করাও যথেষ্ট নয়, স্ত্রীর সম্মতিরও প্রয়োজন। কাজেই উপরোক্ত ভুল ধারণার কোনো অবকাশ নেই। আর পাওনাদারের পাওনা পরিশোধের ক্ষেত্রে চুলচেরা হিসাব করা দোষের বিষয় নয়; বরং হক্ব আদায়ে সতর্কতার কারণে হলে তা প্রশংসনীয়ও বটে। তেমনি পাওনাদারও যদি চুলচেরা হিসাব করে পাওনা বুঝে নিতে চায় তাহলেও তার নিন্দা করার অবকাশ নেই। কারণ এটা তার অধিকার। তবে কুরআন-হাদীসে উভয় পক্ষকেই সহজ ও উদার হওয়ার প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে।
তালাক ও মোহর
لا جناح عليكم ان طلقتم النساء ما لم تمسوهن او تفرضوا لهن فريضة ومتعوهن على الموسع قدره وعلى المقتر قدره متاعا بالمعروف حقا على المحسنين وان طلقتموهن من قبل ان تمسوهن وقد فرضتم لهن فريضة فنصف ما فرضتم الا ان يعفون او يعفو الذى بيده عقدة النكاح وان تعفوا اقرب للتقوى ولا تنسوا الفضل بينكم ان الله بما تعملون بصير
তোমরা গুনাহগার হবে না যদি স্ত্রীদেরকে এমন অবস্থায় তালাক দাও যে, না তাদেরকে স্পর্শ করেছ, না মোহর ধার্য করেছ। (তবে) তাদেরকে দাও কিছু ব্যবহারের সামগ্রী নিয়মানুযায়ী, সচ্ছল ব্যক্তি তার সঙ্গতি অনুসারে আর অসচ্ছল ব্যক্তি তার সামর্থ্য অনুযায়ী। এটা নেককারদের কর্তব্য।
আর যদি তাদেরকে তালাক দাও তাদেরকে স্পর্শ করার আগে এবং তাদের জন্য মোহর ধার্য করে থাক তাহলে যা ধার্য করেছিলে তার অর্ধেক (প্রদান কর) তবে যদি ঐ নারীগণ (তাদের প্রাপ্য) ক্ষমা করে দেয়, কিংবা ঐ ব্যক্তি ক্ষমা করে যার হাতে থাকে বিবাহ-বন্ধন। আর ক্ষমা করাই তাকওয়ার নিকটতর। তোমরা নিজেদের মাঝে সহৃদয়তার কথা ভুলে যেয়ো না। নিশ্চয়ই তোমরা যা কর আল্লাহ তা দেখেন। -সূরা বাকারা (২) : ২৩৬-২৩৭
এই আয়াত দুটির মৌলিক বিধান ও শিক্ষা নিম্নরূপ :
১. আকদের সময় মোহর ধার্য না করলেও বিয়ে হয়। এরপর সহবাস হলে কিংবা স্বামী-স্ত্রী একান্তে মিলিত হলে মোহরে মিছ্ল ওয়াজিব হয়। আর সহবাস বা একান্তে সাক্ষাতের আগেই তালাক হয়ে গেলে মোহরের স্থলে মাতা’ ওয়াজিব হয়।
২. কুরআন মজীদে মাতায়ের পরিমাণ ধার্য করা হয়নি। বলা হয়েছে, স্বামী নিজ সঙ্গতি অনুসারে তা প্রদান করবে। ফকীহগণ বলেন, তা পাঁচ দিরহামের কম এবং স্ত্রীর মোহরে মিছ্লের অর্ধেকের বেশি না হওয়া বাঞ্ছনীয়।
৩. আকদের সময় মোহর ধার্য থাকলে এবং সহবাস বা একান্তে সাক্ষাতের আগে তালাক হয়ে গেলে ধার্যকৃত মোহরের অর্ধেক দিতে হবে। তবে স্ত্রী যদি তার অধিকার ছেড়ে দেয়, কিংবা স্বামী পূর্ণ মোহর প্রদান করে তাহলে কোনো দোষ নেই; বরং তা ছওয়াবের কাজ।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, সদাশয়তার আচরণ করা কিংবা প্রাপ্য ছেড়ে দেওয়া সাধারণ অবস্থায় ছওয়াবের কাজ হলেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা না-করাও উত্তম ও অগ্রগণ্য হতে পারে। যেমন কারো পাওনা ত্যাগের ইচ্ছা থাকলেও যদি অর্থের প্রয়োজন থাকে এবং পাওনা ত্যাগ করলে অসুবিধায় পড়ে যাওয়ার ও সবর করতে না পারার আশঙ্কা থাকে সেক্ষেত্রে পাওনা উসূল করাই সমীচীন। (দেখুন : আহকামুল কুরআন, জাসসাস ১/৪৩৩-৪৪২; বয়ানুল কুরআন ১/১৪০-১৪১
সুন্দর ভাবে বিদায় দাও
يا ايها الذين آمنوا اذا نكحتم المؤمنت ثم طلقتموهن من قبل ان تمسوهن فما لكم عليهن من عدة تعتدونها فمتعوهن وسرحوهن سراحا جميلا
হে মুমিনগণ! তোমরা মুমিন নারীদেরকে বিয়ে করার পর তাদেরকে স্পর্শ করার আগে যদি তালাক দাও তাহলে তোমাদের জন্য তাদের পালনীয় কোনো ইদ্দত নেই, যা তোমরা গণনা করবে। তাদেরকে কিছু সামগ্রী দাও এবং সুন্দরভাবে রোখসত কর। -সূরা আহযাব (৩৩) : ৪৯
বিয়ের পর কোনো কারণে সহবাস ও স্বামী-স্ত্রীর একান্ত সাক্ষাতের আগেই যদি তালাক হয়ে যায় তাহলে স্ত্রী কোন অবস্থায় কতটুকু মোহর পায় তা সূরা বাকারার (২৩৬-২৩৭) আয়াতে বলা হয়েছে। এই আয়াতের অর্থ ঐ আয়াতের আলোকেই বুঝতে হবে। অর্থাৎ আকদের সময় মোহর ধার্য থাকলে অর্ধেক মোহর দিতে হবে। আর ধার্য না থাকলে কাপড়-চোপড় ইত্যাদি দিতে হবে। (দেখুন : তাফসীরে ইবনে কাছীর ৩/৭৯৩)
এই আয়াতে ইদ্দত সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, এ অবস্থায় নারীকে ইদ্দত পালন করতে হবে না। আয়াতের শেষাংশে ‘সুন্দরভাবে রোখসত করা’র আদেশ দেওয়া হয়েছে। নারীর পাওনা পুরাপুরি আদায় করা সুন্দর রোখসতের প্রধান শর্ত। তাছাড়া বিচ্ছেদের সময় নারীকে অপমানিত না করা, কটুকথা না বলা এবং অন্য কোনোভাবে কষ্ট না দেওয়াও এই নির্দেশের অন্তর্ভুক্ত। ( দেখুন : বয়ানুল কুরআন)
এটাই তাকওয়া!
وللمطلقت متاع بالمعروف حقا على المتقين
এবং তালাকপ্রাপ্তা নারীগণ পাবে সম্পদ ও সামগ্রী নিয়মানুযায়ী, যা (প্রদান করা) খোদাভীরু পুরুষের দায়িত্ব।-সূরা বাকারা (২) : ২৪১
আরবীতে متاع অর্থ ما يتمت
অর্থাৎ যা কিছু মানুষ ভোগ-ব্যবহার করে। বৈবাহিক সম্পর্কের কারণে নারী যা কিছু পায়, যেমন মোহর, খোরপোষ এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিছু সামগ্রী বা জামা-কাপড় ইত্যাদি সবকিছুই এতে শামিল হতে পারে। তবে কোন অবস্থায় কী ধরনের সম্পদ বা সামগ্রী তার প্রাপ্য তা অন্যান্য আয়াতে ও হাদীস শরীফে সুনির্দিষ্টভাবে বলা হয়েছে। এই নিবন্ধেও ইতিপূর্বে বিভিন্ন আয়াতের আলোচনায় তা উল্লেখিত হয়েছে।
কিছুই ফেরৎ নিও না
يا ايها الذين آمنوا لا يحل لكم ان ترثوا النساء كرها ولا تعضلوهن لتذهبوا ببعض ما آتيتموهن الا ان يأتين بفاحشة مبينة وعاشروهن بالمعروف فان كرهتموهن فعسى ان تكرهوا شيئا ويجعل الله فيه خيرا كثيرا وان اردتم استبدال زوج مكان زوج وآتيتم احداهن قنطارا فلا تأخذوا منه شيئا اتأخذونه بهتانا واثما مبينا وكيف تأخذونه وقد افضى بعضك الى بعض واخذن منك ميثاقا غليظا
হে মুমিনগণ! তোমাদের জন্য বৈধ নয় বলপূর্বক নারীদের (জান-মালের) মালিক হয়ে যাওয়া। তোমরা তাদেরকে যা দিয়েছিলে তার কিছু অংশ আত্মসাৎ করার জন্য তাদেরকে আটকে রেখো না যদি না তারা লিপ্ত হয় স্পষ্ট গর্হিত কর্মে। তাদের সাথে সৎভাবে জীবন যাপন করো। তাদেরকে যদি অপছন্দ কর তাহলে হতে পারে, তোমরা এমন জিনিসকে অপছন্দ করছ, যাতে আল্লাহ প্রভূত কল্যাণ রেখেছেন।
আর যদি এক স্ত্রীর জায়গায় অন্য স্ত্রী গ্রহণ করতে চাও এবং তাদের একজনকে অগাধ সম্পদও দিয়ে থাক তবুও তা থেকে কিছুই ফেরত নিও না। তোমরা কি তা ফেরত নেবে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে ও স্পষ্ট পাপকর্মে লিপ্ত হয়ে?
আর কীভাবে তা ফেরত নেবে যখন তোমরা একে অপরের সাথে একান্তে মিলিত হয়েছ এবং তারা নিয়েছে তোমাদের দৃঢ় অঙ্গিকার?-সূরা নিসা : ১৯-২১
এই আয়াতগুলোতে নারীর প্রতি ঐসব নির্যাতন নিষিদ্ধ করা হয়েছে, যা ইসলামপূর্ব জাহেলী সমাজে ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল। নিজের সত্তা ও সম্পদের উপর নারীর কোনো অধিকার ছিল না। কারো মৃত্যুর পর ওয়ারিশরা যেমন তার সম্পদের উত্তরাধিকারী হত তেমনি তার স্ত্রীর উপরও ওয়ারিশদেরই কতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হত। ইচ্ছে হলে নিজেরাই তাকে বিয়ে করত, ইচ্ছে হলে অন্যত্র বিয়ে দিতে এবং মোহরের অর্থ আত্মসাৎ করত। উত্তরাধিকার সম্পদ থেকে বঞ্চিত করা, মোহর পরিশোধ না করা, পরিশোধ হলেও যখন ইচ্ছা জোর-জবরদস্তি বা কুটকৌশলের মাধ্যমে ফেরত নেওয়া ইত্যাদি ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল। ঐসব প্রথা ও প্রচলন চিরতরে নিষিদ্ধ করে কুরআন মজীদ নারীকে তার সত্তা ও সম্পদের ন্যায্য অধিকার প্রদান করেছে। এটা এ নিবন্ধের আলোচ্য বিষয় নয়। এখানে শুধু মোহর সংক্রান্ত কিছু নীতি ও বিধান সংক্ষেপে উল্লেখ করছি।
১. মোহরের উপর নারীর অধিকার সাব্যস্ত হওয়ার পর তা পরিশোধ না করা, কিংবা অন্যায়ভাবে ফেরত নেওয়া সম্পূর্ণ অবৈধ ও হারাম।
২. বিবাহের পর স্বামী-স্ত্রীর সহবাস হলে কিংবা একান্তে সাক্ষাত হলে, যাকে পরিভাষায় ‘খালওয়াতে সহীহা’ বলে, পূর্ণ মোহর সাব্যস্ত হয়। আকদের সময় মোহর ধার্য হলে ধার্যকৃত পূর্ণ মোহর আর ধার্য না হলে মোহরে মিছল প্রাপ্য হয়। এটা পরিশোধ না করা বা পরিশোধের পর কিছু অংশও অন্যায়ভাবে ফেরত নেওয়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ও হারাম।
৩. বিশাল অংকের মোহর ধার্য করা যদিও কাম্য নয়, কিন্তু ধার্য করলে পরিশোধ করা অপরিহার্য।
৪. উপহার হিসেবে স্ত্রীকে যা কিছু দেওয়া হয়েছে কিংবা উত্তরাধিকার সূত্রে নারী যা কিছু লাভ করেছে তার কিছু পরিমাণও তার স্বতঃস্ফূর্ত সম্মতি ছাড়া নিয়ে নেওয়া বৈধ নয়; না স্বামীর জন্য, না অন্য কারো জন্য।
৫. এখানে খোলার বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি পাওয়া যায়, যা পরের আয়াতের আলোচনায় বলা হবে ইনশাআল্লাহ। (দেখুন : আহকামুল কুরআন, জাসসাস ২/১০৯-১১১; তাফসীরে ইবনে কাসীর ১/৪৬৬-৪৬৭; তাফসীরে উছমানী পৃ. ১০৩-১০৪)
খোলা ও মোহর
الطلاق مرتان فامساك بمعروف او تسريح باحسان ولا يحل لكم ان تأخذوا مما آتيتموهن شيئا الا ان يخافا الا يقيما حدود الله فان خفتم الا يقيما حدود الله فلا جناح عليهما فيما افتدت به تلك حدود الله فلا تعتدوها ومن يتعد حدود الله فاولئك هم الظلمون
ঐ তালাক দুইবার। এরপর হয় (তাকে) রাখবে নিয়ম অনুযায়ী কিংবা মুক্ত করবে সদাশয়তার সাথে। আর তাদেরকে যা দিয়েছিলে তা থেকে কোনো কিছু নেওয়া তোমাদের জন্য বৈধ নয়। তবে (ঐ ক্ষেত্রে বৈধ হয়) যখন উভয়ের আশঙ্কা হয় যে, তারা আল্লাহর সীমারেখা রক্ষা করবে না। সুতরাং তোমাদের যদি আশঙ্কা হয়, তারা আল্লাহর সীমারেখা রক্ষা করবে না তাহলে স্ত্রী যা কিছুর বিনিময়ে নিষ্কৃতি লাভ করে তাতে তাদের কারো অপরাধ হবে না। এগুলো আল্লাহর বিধান। সুতরাং তোমরা তা লঙ্ঘন করো না। আর যারা আল্লাহর বিধান লঙ্ঘন করে তারাই হল জালিম।-সূরা বাকারা : ২৯৯
এই আয়াতে অন্যায়ভাবে মোহর ফেরত নেওয়া কিংবা মোহরের দাবি পরিত্যাগে বাধ্য করাকে নিষিদ্ধ ও হারাম করা হয়েছে। যেমন কোনো কোনো অত্যাচারী স্বামী স্ত্রীকে রাখতেও চায় না আবার নিয়মানুযায়ী তাকে মুক্তও করে না, পরিশেষে স্ত্রী অতিষ্ঠ হয়ে গেলে তার কাছে অর্থকড়ি দাবি করে। উপরের আয়াতে এ ধরনের কাজকে হারাম করা হয়েছে। আয়াতের শেষাংশে ‘খোলা’র বিধান বর্ণনা করা হয়েছে। বিস্তারিত মাসায়েল ফিকহের কিতাবে রয়েছে। এখানে প্রাসঙ্গিক অংশটুকু আলোচনা করা যায়।
খোলা বিবাহ-বিচ্ছেদের একটি বিশেষ প্রক্রিয়া, যাতে অর্থের বিনিময়ে স্ত্রী নিজেকে বিবাহ-বন্ধন থেকে মুক্ত করে। যেহেতু এখানে স্ত্রীর অর্থ প্রদানের বিষয় থাকে তাই সম্পূর্ণ বিষয়টি তার সম্মতির উপর নির্ভরশীল। স্ত্রীর সম্মতি ছাড়া খোলা সম্পন্ন হয় না।
এরপরও পুরুষের উপর কিছু বিধিনিষেধ আরোপিত হয়েছে, যা অমান্য করলে সে আল্লাহর কাছে অপরাধী হয়ে যাবে। বিধানগুলো এই-
১. স্বামী-স্ত্রীর অমিল ও বিবাহ-বিচ্ছেদের মূল কারণ যদি স্বামী হয়ে থাকে, অর্থাৎ অন্য স্ত্রী গ্রহণে তার আগ্রহ যদি খোলার মূল প্রেরণা হয় তাহলে স্ত্রীর সম্মতির পরও তার নিকট থেকে অর্থ গ্রহণ স্বামীর জন্য বৈধ নয়। সূরা নিসায় আল্লাহ তাআলা বলেছেন, (তরজমা) আর যদি এক স্ত্রীর জায়গায় অন্য স্ত্রী গ্রহণ করতে চাও এবং তাদের একজনকে অগাধ সম্পদ দিয়ে থাক তবুও তা থেকে কিছুই ফেরৎ নিও না।’ এক্ষেত্রে স্বামীর কর্তব্য হল, অর্থ গ্রহণ ছাড়া তালাক দিয়ে দেওয়া এবং সহজ ও সুন্দরভাবে স্ত্রীকে মুক্ত করা।
২. খোলা-চুক্তিতে ধার্যকৃত অর্থ মোহরের চেয়ে বেশি হতে পারবে না। স্ত্রীর সম্মতি থাকলেও স্বামীর জন্য তা গ্রহণ করা বৈধ নয়। নতুবা তাকে আল্লাহর আদালতে অপরাধী হতে হবে। উপরোক্ত আয়াতে ‘স্ত্রী যা কিছুর বিনিময়ে নিষ্কৃতি লাভ করে’ কথায় শব্দগত ব্যাপকতা থাকলেও অনেক মনীষী মনে করেন, এখানে ঐ সম্পদের কথাই বলা হয়েছে, যা ইতিপূর্বে (‘তাদেরকে যা দিয়েছিল তা থেকে কোনো কিছু নেওয়া তোমাদের জন্য বৈধ নয়’ শব্দে) বলা হয়েছিল অর্থাৎ মোহর। (দেখুন : আহকামুল কুরআন, তহাবী ২/৪৫৩)
দ্বিতীয়ত : সুন্নাহর বিধান দ্বারাও প্রতীয়মান হয় যে, মোহরের অধিক গ্রহণ করা স্বামীর জন্য বৈধ নয়।
আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা. বলেন, ছাবিত ইবনে কায়সের স্ত্রী নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট এসে বলল, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! ছাবিত ইবনে কায়সের চরিত্র ও দ্বীনদারি সম্পর্কে আমার কোনো অভিযোগ নেই। কিন্তু একজন মুসলিম নারী হয়ে স্বামীর প্রতি অকৃতজ্ঞতার পাপ আমি বহন করতে চাই না।’ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘তুমি কি তার বাগানটি ফেরত দিবে?’ তিনি বললেন, ‘জ্বী হাঁ।’ তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছাবিত ইবনে কায়সকে বললেন, ‘বাগানটি ফেরত নাও এবং তাকে এক তালাক দাও।’-সহীহ বুখারী
অন্য রেওয়ায়েতে আছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি কি তার বাগানটি ফেরত দিবে’ তখন তিনি বলেছিলেন, ‘জ্বী; বরং আরো কিছু বেশি দিব।’ তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘বাগানটি ফেরত দাও (যা মোহর হিসেবে দেওয়া হয়েছিল)। অতিরিক্ত কিছু দিতে হবে না।’
৩. স্ত্রীর অপারগ অবস্থার সম্মতি, কিংবা ‘খোলা’ শব্দের অর্থ না বুঝেই সম্মতি-বাক্য উচ্চারণ শরীয়তের দৃষ্টিতে সম্মতি হিসেবে গণ্য নয়। মোটকথা, পুরুষের জন্য খোলার অর্থ গ্রহণ কেবল তখনই বৈধ হয়, যখন বিবাহ-বিচ্ছেদের মূল কারণ হয় স্ত্রীর অবাধ্যতা কিংবা স্বামী-স্ত্রী উভয়ের ক্রোধ ও বিরূপতা তেমনি খোলার অর্থ মোহরের চেয়ে বেশি না হয়, সর্বোপরি পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে চুক্তি সম্পন্ন হয়। এর কোনো একটি শর্ত লঙ্ঘিত হলেও খোলার অর্থ গ্রহণ স্বামীর জন্য বৈধ থাকে না।
(দেখুন : আহকামুল কুরআন, জাসসাস ১/৩৯২-৩৯৫)
প্রসঙ্গত জেনে রাখা ভালো যে, শরীয়তসম্মত কারণ ছাড়া বিবাহ-বিচ্ছেদ প্রশংসনীয় নয়। শুধু স্বভাগত কারণে বিবাহ-বিচ্ছেদ ঘটানো খুবই নিন্দনীয়। এজন্য পুরুষকে যেমন স্বভাবগত পছন্দ-অপছন্দের উপর কল্যাণ-অকল্যাণের বিবেচনাকে প্রাধান্য দিতে বলা হয়েছে তেমনি নারীকেও বলা হয়েছে শুধু আবেগ-অভিমান দ্বারা পরিচালিত না হতে এবং শরীয়তসম্মত কারণ ছাড়া স্বামীর কাছে খোলার প্রস্তাব না দিতে।
হযরত ছাওবান রা. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে নারী বিনা কারণে স্বামীর কাছে তালাক প্রার্থনা করে সে জান্নাতের ঘ্রাণও পাবে না।-আহমদ; তিরমিযী; আবু দাউদ; ইবনে মাজাহ; দারেমী-মিশকাতুল মাসাবীহ ২৮৩
অন্য হাদীসে আছে, ‘ঐ সকল নারীই হল মুনাফিক, যারা স্বামীর অবাধ্য হয় এবং যারা স্বামীর নিকট খোলার প্রার্থনা করে।’ -নাসায়ী -মিশকাতুল মাসাবীহ ২৮৪
(মাসিক আল কাউসার,জমাদার উখরা -১৪৩২, মে-২০১১)