*যাকাত আদায়ের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব:
পবিত্র কুরআনুল করিমে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন-
فسأكتبها للذين يتقون و يؤتون الزكوة و الذين هم بايتنا يؤمنون
সুতরাং অবিলম্বে আমি নিয়ামাতরাজী তাদের জন্যই লিপিবদ্ধ করে দেবো,যারা ভয় করে,যাকাত দেয় এবং যারা আমার নিদর্শনসমুহের উপর ঈমান আনে। (সূরা আ‘রাফ: ১৫৬)
আবু হুরাইরা রা: হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহ তা‘আলা যাকে সম্পদ দিয়েছেন অথচ সে তার যাকাত আদায় করে না, কিয়ামত দিবসে তার সম্পদকে দুই চোখ বিশিষ্ট বিষাক্ত সাপে পরিণত করা হবে। তারপর সাপটিকে কিয়ামতের দিবসে তার গলায় জড়িয়ে দেয়া হবে। সাপ তার দুই মুখে দংশন করতে করতে বলতে থাকবে, আমি তোমার বিত্ত, আমি তোমার গচ্ছিত সম্পদ।’ (বুখারী শরীফ)
*যাদের ওপর যাকাত ওয়াজিব:
যাদের ওপর যাকাত ওয়াজিব তারা তিন প্রকার:
১. নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক।
২. যাদের সম্পদের ওপর পূর্ণ এক বছর অতিবাহিত হয়েছে। তবে ফসলের ক্ষেত্রে এক বছর অতিবাহিত হওয়া জরুরি নয় বরং ফসলের যাকাতের সম্পর্ক ফসল পাকার সাথে।
৩.ফলের যাকাত ওয়াজিব হয় যখন তা পরিপক্কতা লাভ করে এবং খাওয়ার উপযোগী হয়।
* যাকাত ওই সব লোকের ওপর ওয়াজিব হয় যাদের নিকট সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ (৮৫ গ্রাম) বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা (৫৯৫ গ্রাম) রৌপ্য অথবা তৎসমান অর্থ প্রয়োজনের অতিরিক্ত এক বছর যাবৎ রিজার্ভ বা জমা আছে।
*স্বর্ণ রুপার ওপর যাকাত ওয়াজিব হয়:
বর্তমান বাজার অনুসারে স্বর্ণ ও রৌপ্যের মূল্যের ব্যবধান অনেক বেশি। তবে দরিদ্র, অসহায় ও মিসকিনদের সুবিধা বিবেচনায় রুপার মূল্যই জাকাত ওয়াজিব হওয়ার ক্ষেত্রে বিবেচনা করা উচিৎ। তাই বলা যায় সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপার মূল্য (বর্তমান বাজার অনুসারে ৪০-৪২ হাজার টাকা) প্রয়োজনের অতিরিক্ত বিদ্যমান থাকার অর্থই হল তার ওপর যাকাত ওয়াজিব। তবে এ অবস্থায় যাকাত ওয়াজিব হওয়ার দু’টি শর্ত আছে, এক. ঋণগ্রস্ত না হতে হবে। দুই. অতিরিক্ত সম্পদের মেয়াদ এক বছর পার হতে হবে।
*যেসব সম্পত্তিতে যাকাত ওয়াজিব হয় :
প্রথমত– জমিনে উৎপাদিত ফসল, ফল ও বীজের ওপর যাকাত ওয়াজিব। আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন, ‘তোমরা জমিনের ফসল খাও যখন ফসল ফলে, আর ফসল কাটার সময় ফসলের হক্ব আদায় কর। তোমরা অপচয় করো না। নিশ্চয় তিনি অপচয়কারীদের পছন্দ করেন না।’ (সূরা আনাম : ১৪১)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘বৃষ্টির পানি অথবা সমুদ্রের পানি দ্বারা উৎপাদিত ফসলে দশ ভাগের এক ভাগ আর সেচের মাধ্যমে উৎপাদিত জমিনের ফসলে বিশ ভাগের এক ভাগ যাকাত দিতে হবে।’ তবে হাদিসের ভাষায় ফসলের পরিমাণ পাঁচ ওছাক হতে হবে।
দ্বিতীয়- গবাদি পশু যেমন- উট, গরু, ছাগল ইত্যাদির ওপর জাকাত ওয়াজিব।
আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন, ‘এবং গৃহপালিত পশু যা তোমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন এর মধ্যে রয়েছে শীত বস্ত্রের উপকরণ এবং মানুষের জন্য উপকার।’ (সূরা নাহাল : ৫-৬)
এসব জীব-জন্তুর যাকাত ওয়াজিব হবে যখন মুক্ত বিচরণকারী এবং নিসাব পরিমাণ হয়। এসবের মধ্যে উটের নিসাব হল কমপক্ষে পাঁচটা আর গরু ত্রিশটি এবং ছাগল চল্লিশটি। কিন্তু মুক্ত বিচরণকারী না হলে যাকাত ওয়াজিব হবে না। তবে যদি ব্যবসার উদ্দেশ্য থাকে তাহলে অবশ্যই যাকাত আদায় করতে হবে।
তৃতীয়- স্বর্ণ, রৌপ্যেও যাকাত ওয়াজিব। স্বর্ণ ও রৌপ্য যে কোন ধরনের হোক না কেন এর যাকাত ওয়াজিব। তবে স্বর্ণের পরিমাণ কমপক্ষে সাড়ে সাত তোলা এবং রৌপ্যের পরিমাণ সাড়ে বায়ান্ন তোলা হতে হবে।
চতুর্থ– ব্যবসার মালামালের মধ্যে যাকাত ওয়াজিব। জমি, গবাদি পশু, খাদ্য-পানীয় ইত্যাদি সবকিছুতেই যাকাত ওয়াজিব যদি ব্যবসার উদ্দেশ্য থাকে। সুতরাং মালিককে বছর শেষে হিসাব করে এসবের যাকাত পরিশোধ করতে হবে।
*যাকাতের অর্থ ব্যয়ের খাতসমূহ :
আল্লাহ তা’আলা কুরআন পাকে যাকাতের অর্থ ব্যয়ের খাতসমূহ উল্লেখ করে দিয়েছেন। কুরআনে জাকাতের অর্থ ব্যয়ের জন্য ৮টি খাত উল্লিখিত হয়েছে।
আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেনو
انما الصدقات و المساكين و العاملين عليها و المؤلفة قلوبهم و في الرقاب و الغارمين و في سبيل الله و ابن السبيل فريضة من الله و الله عليم حكيم
১। ফকির: ফকির যারা নিজেদের সাধারণ জীবন যাপন করতে পারে না। অনেক দুঃখে-কষ্টে কালাতিপাত করে- তাদেরকে যাকাত দেয়া হবে। হাদীস শরিফে বলা হয়েছে তোমাদের মধ্যে যারা ধনী তাদের থেকে যাকাত নেয়া হবে, আর গরিবের মাঝে বিতরণ করা হবে।’ সূরা তাওবা – 60
২। মিসকিন: সহায়-সম্বলহীন হৃতসর্বস্ব ব্যক্তি যার নিকট নগদ অর্থ বলতে কিছুই নেই- এমন লোকদের যাকাত দেয়া হবে।
৩। কর্মকর্তা_কর্মচারী: যাকাতের পয়সা বা সম্পদ উসুল করার কাজে নিয়োজিত কর্মচারী কর্মকর্তাদের বেতন ভাতার কাজে যাকাতের অর্থ ব্যয় করা হবে। চাই এরা ধনী হোক অথবা গরিব। সর্বাবস্থায় এ যাকাতের থেকে তারা তাদের বেতন ভাতা গ্রহণ করতে পারবে।
৪। কৃতদাসকে মুক্তকরার_জন্য: কৃতদাস বা কৃতদাসীকে মুক্ত করার জন্য যাকাতের অর্থ ব্যয় করা যাবে।
৫। মুআল্লাফাতে কুলুব: অমুসলিম বা কাফের সম্প্রদায়ের জন্য যাকাতের অর্থ ব্যয় করা যাবে। যাতে তারা ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হয়। তাদের অন্তরে ইসলাম ও মুসলমানদের প্রতি আকর্ষণ বোধ করে। একমাত্র এ ধরনের কোন উদ্দেশ্য ছাড়া অমুসলিমদের মধ্যে যাকাতের অর্থ ব্যয় করা যাবে না।
৬। ঋণগ্রস্ত: ঋণগ্রস্ত কোন ব্যক্তির ওপর তার ঋণের বোঝা কমানো বা ঋণ মুক্ত করার উদ্দেশ্যে যাকাতের অর্থ ব্যয় করা যাবে।
৭। ফি-সাবিলিল্লাহ খাত: ফি সাবিলিল্লাহ বলতে যারা আল্লাহর পথে বিভিন্নভাবে জিহাদরত তাদের সার্বিক সাহায্যার্থে যাকাতের অর্থ প্রদান করা যাবে।
৮। মুসাফিরদের জন্য: কোন মুসাফির ব্যক্তি পথিমধ্যে অর্থাভাবে বিপদগ্রস্থ বা অসহায় হয়ে পড়েছে। বাড়ী পর্যন্ত পৌঁছার মত কোন সম্বল তার সঙ্গে নেই। এমতাবস্থায় যাকাতের অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করা বা লোকটির জন্য যাকাতের অর্থ গ্রহণ করা সম্পূর্ণ বৈধ।
যাকাত আদায় করার দায়িত্ব:
যাকাত আদায় করার দায়িত্ব সরকার বা রাষ্ট্রের। কিন্তু সমকালীন দুনিয়ায় ইসলামী অনুশাসন না থাকায় কোথাও যাকাত ভিত্তিক অর্থনীতি চালু নেই। তাই ব্যক্তিগত উদ্যোগে যাকাত দিতে হবে। অন্যথায় যাকাত অনাদায়ের যে শাস্তি নির্ধারিত আছে তার অবধারিত কবল থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় নেই। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সবাইকে বুঝার এবং তদনুযায়ী আমল করবার তাওফিক দান করুন,আমিন।
(মুফতি আল্লামা সৈয়দ মুহাম্মদ অছিউর রহমান মঃজিঃআঃ এর আলোচনার আলোকে।)