শরহু মাআনিল আসার- তাহাবী শরীফঃ 

যে সকল মনীষীর যাদু কাঠির পরশে ফিক্হ শাস্ত্র উৎকর্ষের সোপান বেয়ে মর্যাদার শৈল চূড়ায় এবং উন্নতি গিরিশৃঙ্গে সমাসীন হয়েছে তাদের মধ্যে যুক্তিবাদী, সুপণ্ডিত ইমাম আবু জা’ফর তাহাবী (রহ:) ছিলেন ফিক্হ শাস্ত্র গগনের দীপ্তরবি। ইমাম তাহাবী রহঃ কর্তৃক রচিত একিতাবে রয়েছে হাদীসে রাসূলের বিরাট ভান্ডার।

শরহু মাআনিল আসার- তাহাবী শরীফ রচনার কারণ-

ইমাম তাহাবী (রহ:) شرح معانى الاثار তাঁর কিতাবের ভূমিকা লিখেন- قال ابو جعفر الطحاوى (رح) سألنى بعض اصحابنا من اهل العلم ان اضع له كتابا اذكر فيه الاثار المأثورة عن رسول الله صلى الله عليه وسلم فى الاحكام التى يتوهم اهل الالحاد والضعفة من اهل الاسلام ان بعضها ينقض بعضا لقلة علمهم بنا سخها من منسوخها وما يجب به العمل منها لها يشهدله من الكتاب الناطق والسنة المجتمع عليها واجعل لذلك ابوابا اذكر فى كل كتاب منها ما فيه من الناسخ والمنسوخ وبأويل العلماء واحتجاج بعضهم على بعض واقامة الحجة لمن صح عندى قوله منهم بما يصح به مثله من كتاب او سنة او اجماع او تواتر من اقاويل الحابة او تابعيهم- وانى نظرت فى ذلك وبحثت عنه بحثا شديدا- فاستخرجت منه ابوابا على النحو الذى سأل وجعلت ذلك كتبا- ذكرت فى كل كتاب منها جنسا من تلك الاجناس-

অর্থ: ইমাম আবু জা’ফর আহমদ ইবন সালামা ইবন সালমা আল-আযদী-আত তাহাবী (রহ:) বলেনঃ আমার এক জ্ঞান পিপাসু সুহৃদ বন্ধু আমার নিকটএ মর্মে অনুরোধ জ্ঞাপন করলেন যে, আমি যেন তাঁর জন্য একটি বিশেষ গ্রন্থ রচনার ব্রতী হই, যাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে সূত্র পরস্পরায় বর্ণিত আহকাম (বিধানাবলী) সংশ্লিষ্ট বাণীসমূহ সন্নিবেশিত করি। এসব বিধান নিয়ে অবিশ্বাসী নাস্তিকেরা ও দুর্বলমতি মুসলমানের (হাদীস অস্বীকাকারী ভ্রান্ত দল) ‘নাসিখ’ (রহিতকারী) ও ‘মানসূখ’ (রহিত) সম্পর্কে তাদের স্বল্পজ্ঞান হেতু এবং প্রজ্ঞাময় কুরআন ও ঐকমত্য দ্বারা প্রতিষ্ঠিত সুন্নাহর সাক্ষ্য ও সমর্থনের ভিক্ততে যে সব বিধানের উপর আমল করা আবশ্যক; কিন্তু এ সম্পর্কে তাদের স্বল্পজ্ঞান হেতু এ মর্মে অমূলক ধারণা পেষণ করে যে, আল্লাহর কতক বিধান অপর কতক বিধানের সাথে পাস্পরিক সাংঘর্ষিক।

তিনি আরো অনুরোধ করলেন, আমি যেন গ্রন্থিটিকে বিভিন্ন অনুচ্ছেদে বিভক্ত করি। গ্রন্থটির প্রতিটি অধ্যায়ে ‘নাসিখ’ ‘মানসূখ’, বিশেষজ্ঞ আলিম-মনীষীদের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণসমূহ যেন সন্নিবেশিত থাকে। আর বিশেষজ্ঞ আলিম-মনীষীদের যে সব মত আমার নিকট বিশুদ্ধ হিসাবে বিবেচিত হবে, সেগুলোকে কুরআন বা সুন্নাহ অথবা ইজমা কিংবা সাহাবা ও তাবেঈগণের অবিচ্ছিন্ন ধারাবাহিক অভিমতগুলো প্রমাণাদি দ্বারা যেভাবে অনুরূপ বিধান বিশুদ্ধরূপে প্রমাণ করা হয় সেভাবে প্রমাণ প্রতিষ্ঠিত করতে সচেষ্ট হই।

আমি বিষয়টির প্রতি অত্যন্ত গুরুত্ব প্রদান করে নিতান্ত নিবিড়ভাবে চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছি। তিনি যেমনটি চেয়েছিলেন সেভাবেই বিভিন্ন বিষয়ে তাৎপর্যপূর্ণ আলোচনার অবতারণা করে তা প্রমাণিত করতে চেষ্টা করেছি। আমি গ্রন্থটিকে বিভিন্ন অধ্যায়ে বিভিক্ত করে প্রতিটি অধ্যায়ে সংশ্লিষ্ট হাদীসসমূহ অবতারণা করেছি।

অতএব আমি সর্বপ্রথম সংশ্লিষ্ট বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে তাহারাত সম্পর্কে হাদীসসমূহ দ্বারা সূচনা করেছি।

শরহু মাআনিল আসার- তাহাবী শরীফের বৈশিষ্ট্যাবলি:-

যুগশ্রেষ্ঠ ফিকহবিদ ইমাম আবু জা’ফর তাহাবী (রহ:) কর্তৃক রচিত জগতবিখ্যাত ও আলোড়ন সৃষ্টিকারী গ্রন্থ ‘শারহু মা’য়ানিল আছার’ এর অনেক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যেমন-

০১। এ গ্রন্থে হাদীসের আলোকে ফিকহি মাসয়ালার বিবরণ পেশ করা হয়েছে।

০২। এ গ্রন্থে এরূপ অনেক হাদীস রয়েছে যা অন্য কোন গ্রন্থে পাওয়া যায় না।

০৩। এ গ্রন্থে বর্ণিত হাদীসসমূহের সনদ জারালো। দুর্বল সনদের কোন হাদীস এ গ্রন্থে নেই।

০৪। এ গ্রন্থের মূল ভাষ্যে অনেক ফায়দা রয়েছে। যেমন- এ গ্রন্থটিকে মাসয়ালা বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে, যা অন্যান্য কিতাবে সংক্ষেপ আকারে বর্ণনা করা হয়েছে।

০৫। এ গ্রন্থে সাহাবী, তাবেয়ী ও অন্যান্য ইমামদের এমন কিছু বাণী রয়েছে যা সমসাময়িক অন্যান্য ইমামদের গ্রন্থে পাওয়া যায় না।

০৬। এ গ্রন্থে গ্রন্থকার প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিসদের অসংখ্য উক্তি পেশ করেছেন।

০৭। গ্রন্থকার এ কিতাবে ফিকহী মাসয়ালাসমূহ বর্ণনা করার সাথে সাথে হাদীসের আলোকে পক্ষের ও বিপক্ষের অভিমত পেশ করেছেন। যা একটি অতুলনীয় গ্রন্থ।

০৮। গ্রন্থকার এ গ্রন্থকে ফিকহ শাস্ত্রের গ্রন্থাবলি অনুযায়ী বিন্যস্ত করেছেন। তারপর সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ইমামদের মতবেধসহ তাদের পক্ষের হাদীসমূহ বর্ণনা করেছে। অতঃপর হাদীসের আলোকে প্রতিপক্ষের উত্তর দিয়েছেন। সর্বশেষে স্বীয় সুচিন্তিত ও যুক্তিপূর্ণ অভিমত উপস্থাপন করেছেন, যা সর্বজন সবীকৃত ও গৃহীত। এ ধরনের কিতাব সত্যিই বিরল।

০৯। গ্রন্থকার এ গ্রন্থে হানাফী মাযহাবের প্রাধান্য দিতে গিয়ে আহনাফের দলিলসমূহ বর্ণনা করার সাথে সাথে বিরুদ্ধবাদীদের দলিলসমূহও বর্ণনা করেছেন। তাই আল্লামা আমীর আতকানী বলেছেন যে, যদি কেউ শারহু মা’য়ানিল আচারের প্রতি গভীর চিন্তা ভাবনা করে, তাহলে তার আমাদের হানাফী মাযহাব ব্যতীত অন্যান্য মাযহাবের জ্ঞানও অর্জিত হবে।

১০। এ গ্রন্থে একই সনদের অসংখ্য হাদীস আনা হয়েছে। যা অপর কোন গ্রন্থে পরিলক্ষিত হয় না।

১১। এ গ্রন্থে একই সনদের অসংখ্য হাদীস, ফিকহবিদগণের উক্তি এবং ইমামদের جرح ও تعديل এর বর্ণনা করা হয়েছে।

শারহু মা’য়ানিল আছার গ্রন্থের দলিল বর্ণনা পদ্ধতি:

ইমাম আবু জাফর আত্-তাহাবী (রহ:)-এর বিখ্যাত شرح معانى الاثار গ্রন্থে দলিল বর্ণনার পদ্ধতি ছিল নিম্নরূপ-

০১। কুরআনুল কারীম থেকে দলিল: ইমাম তাহাবী (রহ:) তাঁর কিতাবে দলিল বর্ণনার ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম কুরআনুল কারীম থেকে আয়াতের উদ্ধৃতি দিয়েছেন। কেননা, তাঁর মতে, কুরআনুল কারীম হলো শরিয়তের মূল উৎস।

০২। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নত থেকে দলিল: কুরআনুল কারীমের দলিল উদ্ধৃতির পরে ইমাম তাহাবী (রহ:) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদীস থেকে বর্ণনা করেছেন। এক্ষেত্রে তিনি হাদীসের সনদ বিশ্লেষণপূর্বক যা সহীহ বলে জেনেছেন একমাত্র তা-ই উল্লেখ করেছেন। কেননা, দুবূল হাদীসের বর্ণনা তিনি এ কিতাবে করেননি। এছাড়াও একই সনদের অসংখ্য হাদীস এ কিতাবে বর্ণিত হয়েছে।

০৩। সাহাবীদের বক্তব্য থেকে দলিল: সাহাবীদের থেকে যে সব উক্তি ইমাম তাহাবী (রহ:)-এর নিকট ধারাবাহিকভাবে পৌঁছেছে, সে সব বিষয় দলিল হিসেবে তিনি তাঁর কিতাবে বর্ণনা করেছেন।

০৪। সাহাবীদের ঐকমত্য থেকে দলিল: সংশ্লিষ্ট বিষয় সাহাবীদের اجماع তথা ঐকমত্য আলোচনা কিতাবে বর্ণিত হয়েছে।

০৫। তাবেয়ীদের বক্তব্য থেকে দলিল: তাবেয়ীদের বক্তব্য থেকে যাদে বক্তব্য ধারাবাহিকভাবে পৌঁছেছে সে সব বক্তব্যও দলিল হিসেবে তাঁর কিতাব বর্ণিত হয়েছে।

০৬। পরস্পর দু হাদীসের সমাধান: দলিল বর্ণনায় পরস্পর বিরোধী দুটি হাদীস পাওয়া গেলে তা বিশ্লেষণপূর্বক হাদীসের আলোকেই তন্মধ্যে একটিকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। আর এক্ষেত্রে ইমাম আবু হানীফা (রহ:)-এর অভিমতই অগ্রাধিকার পেয়েছে।

০৭। বাস্তবসম্মত যুক্তি পেশ: ইমাম তাহাবী (রহ:) যুক্তি ও বাস্তবতার নিরিখে কুরআন ও হাদীসের অপূর্ব সমন্বয় ঘটিয়েছেন, ফলে প্রদত্ত দলিল আরো সুদৃঢ় ও শক্তিমালী হয়েছে।

০৮। প্রসিদ্ধ ইমামদের বক্তব্য পেশ করণ: দলিল বর্ণনায় আলোচ্য গ্রন্থে অপরাপর ইমামদের বক্তব্যও তুলে ধরা হয়েছে। এক্ষেত্রে কোনো মতবিরোধ পূর্ণ বক্তব্য হলে তাঁর দলিল উল্লেখ পূর্বক তা খণ্ডন করে নিজের দলিলকে শক্তিশালী করেছেন। এজন্যই আল্লামা আতকানী (রহ:) বলেন, যদি কেউ شرح معانى الاثار এর প্রতি গভীর চিন্তাভাবনা করে তবে তার হানাফী মাযহাব ব্যতীত অন্যান্য মাযহাবের জ্ঞানও অর্জিত হবে।

শরহু মাআনিল আসার- তাহাবী শরীফ রচনা পদ্ধতি আল্লামা আবূ জা’ফর তাহাবী (রহ:) কর্তৃক রচিত শারহু মায়ানিল আছার একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ। এটি তিনি এক অভিনব পদ্ধতিতে রচনা করেছেন। বিশ্বব্যাপী ফিকহ ও হাদীসের অসংখ্য গ্রন্থ রয়েছে; কিন্তু কোনো গ্রন্থই এর মতো চমৎকার সজ্জিত নয়। এ গ্রন্থের বর্ণনা পদ্ধতি সম্পর্কে ইমাম সুয়ূতী (রহ:) বলেন, وضعه على نمط منشط لم يظفر به احد من اولى الاخيار- واودع فيه ما يكشف به قناع فرائد الاخيار- وسرد فيه الاحايث بالفاظ رائقة تقر بسماعها عيون الاسماع- وسلك فى سردها مسالك معجبة فائقة تطرب لملاحظتها الطباع-

মুহাদ্দিসগণের নিকট شرح معانى الاثار -এর অবস্থান:  شرح معانى الاثار গ্রন্থটি ইলমে হাদীস ও ইলমে ফিকহের এক অনন্য ও প্রসিদ্ধ কিতাব, যা সকল মুহাদ্দিস ও ফকীরের নিকট নির্ভরযোগ্য ও সমাদৃত। আল্লামা আইনী (রহ:) نخب الافكار গ্রন্থে বলেন- ইমাম তাহাবী (রহ:)-এর নির্ভরযোগ্যতা, আমানতদারিতা, মর্যাদার পূর্ণতা, হাদীসের দক্ষতা, নাসেখ, মানসুখ ও হাদীসের পার্থক্যকরণের দক্ষতার ব্যাপারে ইজমা হয়েছে। তারপর কেউ তাঁর স্থান পূরণ করতে পারেন নি। আল্লামা আইনীর এ বক্তব্য থেকে شرح معانى الاثار এর স্তর অনুমেয়।

قال ابو جعفر الطحاوى (رح) سألنى بعض اصحابنا من اهل العلم ان اضع له كتابا اذكر فيه الاثار المأثورة عن رسول الله صلى الله عليه وسلم فى الاحكام التى يتوهم اهل الالحاد والضعفة من اهل الاسلام ان بعضها ينقض بعضا لقلة علمهم بنا سخها من منسوخها وما يجب به العمل منها لها يشهدله من الكتاب الناطق والسنة المجتمع عليها واجعل لذلك ابوابا اذكر فى كل كتاب منها ما فيه من الناسخ والمنسوخ وبأويل العلماء واحتجاج بعضهم على بعض واقامة الحجة لمن صح عندى قوله منهم بما يصح به مثله من كتاب او سنة او اجماع او تواتر من اقاويل الحابة او تابعيهم- وانى نظرت فى ذلك وبحثت عنه بحثا شديدا- فاستخرجت منه ابوابا على النحو الذى سأل وجعلت ذلك كتبا- ذكرت فى كل كتاب منها جنسا من تلك الاجناس-

অতএব উপরিউক্ত বক্তব্যের বিচারে মুহাদ্দিসীনে কেরাম شرح معانى الاثار কিতাবকে সিহাহ সিত্তার পরে অর্থাৎ তৃতীয় স্তরের হাদীস গ্রন্থ হিসেবে গণ্য করেছেন। প্রথম স্তরে বুখারী শরীফ, মুসলিম শরীফ ও মুয়াত্তায়ে ইমাম মালেক। দ্বিতীয় স্তরে সিহাহ সিত্তার বাকি কিতাবগুলো এবং তৃতীয় স্তরেই এ প্রসিদ্ধ কিতাব।

পরিশেষে বলা যায় যে, ইমাম আবু জা’ফর আহমদ বিন মুহাম্মদ আত তাহাবী (রহ:) বিস্ময়কর প্রতিভার অধিকারী এক কালজয়ী মহাপুরুষ। তার তুলনা তিনি নিজেই। তাঁর রচিত গ্রন্থাবলি যুগে যুগে জ্ঞান পিপাসুর জ্ঞান পিপাসা নিবৃত করবে। বিশেষ করে শারহু মা’য়ানিল আছার গ্রন্থের জন্য হানাফী মাযহাবের অনুসারীগণ তার কাছে চিরদিন ঋণী হয়ে থাকবে।

https://www.facebook.com/share/p/QG1YX4MK2Uaaknau/