ইতিকাফের অসীম ফজিলত রয়েছে। পবিত্র রমযান মাসে ইতিকাফ করা একটি গুরুত্বপূর্ণ ও ফযীলতপূর্ণ আমল। রমযানের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সাথে ইতিকাফের সম্পর্ক সুগভীর। মাহে রমযানের খায়ের, বরকত ও ফযীলত বিশেষত শবেকদরের বরকত ও ফযীলত লাভের শ্রেষ্ঠতম উপায় হচ্ছে ইতিকাফ।এ ছাড়া ইতিকাফ রমযান মাসের এতোই গুরুত্বপূর্ণ একটি আমল যে, তা ইসলামের ‘শিআর’ তথা বিশেষ প্রতীকও বটে। এজন্য রমযানের শেষ দশকে কোনো এলাকার মসজিদ ইতিকাফশূন্য থাকলে পুরো এলাকাবাসী সুন্নতে মুআক্কাদাহ বর্জনের কারণে গুনাহগার হবে। এই ইতিকাফের অসংখ্য ফযীলত ও উপকারিতা রয়েছে। তন্মধ্যে এখানে কয়েকটি উল্লেখ করা হলো। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযি. থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-ﻣﻦ اﻋﺘﻜﻒ ﻳﻮﻣﺎ اﺑﺘﻐﺎء ﻭﺟﻪ اﻟﻠﻪ تعالى ﺟﻌﻞ اﻟﻠﻪ ﺑﻴﻨﻪ ﻭﺑﻴﻦ اﻟﻨﺎﺭ ﺛﻼﺙ ﺧﻨﺎﺩﻕ ﻛﻞ ﺧﻨﺪﻕ ﺃﺑﻌﺪ ﻣﻤﺎ ﺑﻴﻦ اﻟﺨﺎﻓﻘﻴﻦ. قال الهيثمي: ﺭﻭاﻩ اﻟﻄﺒﺮاﻧﻲ ﻓﻲ اﻷﻭﺳﻂ ﻭﺇﺳﻨﺎﺩﻩ ﺟﻴﺪ.‘যে ব্যক্তি আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে একদিন ইতিকাফ করবে, আল্লাহ তাআলা তার এবং জাহান্নামের মাঝে তিন খন্দক (পরিখা) দূরত্ব সৃষ্টি করে দিবেন। প্রতিটি খন্দক আসমান ও জমিনের মধ্যবর্তী দূরত্বের চেয়েও বেশি দূরবর্তী হবে।’[আল-মু‘জামুল আওসাত লিত-তবারানী, মাজমাউয যাওয়ায়েদ ৮/৩৫১-৩৫২; শুআবুল ঈমান ৩/৪২৫, হাদীস: ৩৯৬৫]

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযি. থেকে বর্ণিত অপর এক হাদীসে আছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইতিকাফকারী সম্পর্কে ইরশাদ করেছেন-ﻫﻮ ﻳﻌﻜﻒ اﻟﺬﻧﻮﺏ ﻭﻳﺠﺮﻯ ﻟﻪ ﻣﻦ اﻟﺤﺴﻨﺎﺕ ﻛﻌﺎﻣﻞ اﻟﺤﺴﻨﺎﺕ ﻛﻠﻬﺎ‘ ইতিকাফ, ইতিকাফকারী ব্যক্তিকে গুনাহ থেকে বাঁচিয়ে রাখে এবং তার জন্য সকল নেক আমলকারীর মতো সওয়াব বরাদ্দ করা হয়।’[সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস: ১৭৮১]অর্থাৎ মসজিদে অবস্থান করার কারণে ইতিকাফকারী যেসব আমল করতে অক্ষম যেমন, জানাযায় শরিক হওয়া, অসুস্থদের সেবা করা ইত্যাদি- এসব আমল না করেও তার সওয়াব সে পেতে থাকে। এছাড়াও ইতিকাফের আরো বহু উপকারিতা রয়েছে। যেমন-

১. ইতিকাফের মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের গুরুত্বপূর্ণ একটি সুন্নত আদায় হয়। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর মাদানী জীবনে নিয়মিত প্রতি রমযানের শেষ দশকে ইতিকাফ করতেন। এক রমযানে কোনো কারণে ইতিকাফ ছুটে গেলে পরবর্তী রমযানে বিশ দিন ইতিকাফ করে তা পূরণ করে নিয়েছেন।[সুনানে আবু দাউদ, হাদীস: ২৪৬৩]

২. ইতিকাফকারী অবসর সময়ে কোনো আমল না করলেও তার দিবারাত্রি মসজিদে অবস্থান করাটাই ইবাদত হিসেবে গণ্য হয়।[সহীহ মুসলিম ১/১২৭; মাজমাউয যাওয়ায়েদ ২/১৪৬]

৩. ইতিকাফের সূত্রে ইতিকাফকারী আল্লাহর সর্বাধিক প্রিয় স্থানে এবং জান্নাতের বাগানে অবস্থান করার সৌভাগ্য অর্জন করে। কারণ মসজিদ আল্লাহর সবচেয়ে প্রিয় স্থান এবং জান্নাতের বাগান। [সহীহ মুসলিম ১/২৩৬; জামে তিরমিযী, হাদীস: ৩৮৫১]

৪. ইতিকাফের সুবাদে সর্বদা নামাযের সওয়াব লাভ হতে থাকে এবং গুনাহ মাফ হতে থাকে। কারণ ইতিকাফকারী সর্বদা নামায আদায় এবং ইবাদত বন্দেগীর সুযোগেরই প্রতীক্ষায় থাকে। আর মসজিদে অবস্থান এবং নামাযের অপেক্ষার দ্বারা নামাযের সওয়াব লাভ হয় এবং গুনাহ মাফ হয়। [সহীহ বুখারী, হাদীস: ৬৪৭; সহীহ মুসলিম, হাদীস: ২৫১; মুসতাদরাকে হাকেম ১/২০৬]

৫. সার্বক্ষণিক ফেরেশতাদের পক্ষ হতে রহমত ও মাগফিরাতের দুআ পাওয়া যায়। কারণ নামাযের স্থানে অবস্থানকারীর জন্য ফেরেশতাগণ রহমত ও মাগফিরাতের দুআ করতে থাকেন। [সহীহ বুখারী, হাদীস: ৬৫৯]

৬. ইতিকাফের বদৌলতে অনেক গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা যায়। পাপাচারের সয়লাব থেকে পরিত্রাণের জন্য মসজিদ একটি সুরক্ষিত দুর্গ। এছাড়া সর্বদা নামাযী, নেককার, দ্বীনদার ও ইবাদতগোজার লোকদের সাক্ষাত ও সান্নিধ্য লাভের সুযোগ হয়। কারণ মসজিদে কেবল এ ধরনের লোকেরাই আনাগোনা করে থাকে।

৭. ইতিকাফের মধ্য দিয়ে বান্দা অতুলনীয় একাগ্রতার সাথে তার প্রতিপালকের যিকির ও ইবাদতে মশগুল থাকার সৌভাগ্য অর্জন করে।

৮. ইতিকাফকারী দুনিয়ার নানাবিধ ঝামেলা থেকে মুক্ত হয়ে নিজেকে পুরোপুরি আল্লাহ তাআলার কাছে সমর্পণ করে। এতে ফেরেশতাদের সাথে তার সাদৃশ্য লাভ হয় এবং তার মধ্যে ফেরেশতাসুলভ গুণাবলি শক্তিশালী হয়।

৯. ইতিকাফের মাধ্যমে রমযান ও রোযার যাবতীয় হক ও আদব যথাযথভাবে আদায় করা সহজ হয়।

১০. ইতিকাফের অসীলায় আল্লাহ তাআলার মেহমান হওয়ার সৌভাগ্য লাভ হয়। কেননা মসজিদে আগমনকারী ও অবস্থানকারী সকলেই আল্লাহর বিশেষ মেহমান। আল্লাহ তাআলা জান্নাতে তাদের মেহমানদারির ব্যবস্থা করেন।[সহীহ বুখারী ১/৯১; মাজমাউয যাওয়ায়েদ ২/১৪৯]

১১. শবেকদর প্রাপ্তির উত্তম উপায় হলো ইতিকাফ। কেননা সহীহ হাদীস থেকে প্রমাণিত যে, শবেকদর রমযানের শেষ দশকের কোনো এক রাত। আর ইতিকাফকারীর প্রতিটা মুহূর্ত যেহেতু ইবাদত হিসাবে গণ্য হয় তাই শবেকদরে সে ঘুমিয়ে থাকলেও ইবাদতে কাটানোর সওয়াব লাভ করে। [মাসাইলে রাফ‘আত কাসেমী ৫/১২-১৪]

ইতেকাফ কোথায় থাকবেঃ ইতেকাফের জন্য জুমা মসজিদ শর্ত নয়। বরং শরয়ী মসজিদ শর্ত। কোনো স্থান শরয়ী মসজিদ হওয়ার জন্য ঐ স্থানের উপর-নিচ পুরোটাই মসজিদের জন্য ওয়াকফ হওয়া শরীয়তের নিয়ম। তাই কোনো স্থানে মসজিদ বানাতে হলে ঐ স্থানের উপর-নিচ পুরোটাই মসজিদের জন্য নির্ধারণ করে দিবে। নিচে বা উপরে মসজিদ ব্যতীত অন্য কিছু বানাবে না। তবে জায়গা সংকটের কারণে একটি ভবনের কোনো এক তলাকে মসজিদের জন্য স্থায়ীভাবে ওয়াকফ করে দিলেও কোনো কোনো ফকীহের নিকট তা শরয়ী মসজিদ হয়ে যায়।

জামে মসজিদে বা জুমা মসজিদে যেমন ইতিকাফ করা যায়, তেমনি পাঞ্জেগানা মসজিদেও ইতিকাফ করা যায়। এমতাবস্থায় জুমার নামাজ আদায়ের জন্য শুক্রবার জামে মসজিদে যেতে হবে, এতে ইতিকাফের কোনো ক্ষতি হবে না। জুমার আজানের পর যাবেন এবং নামাজের পর চলে আসবেন। এ সময় আসা-যাওয়ার পথে বা জুমা মসজিদে কারও সঙ্গে কথা বলবেন না, প্রয়োজনে ইশারায় বা সংকেতে নির্দেশ ও উত্তর প্রদান করবেন।

পাঞ্জেগানা মসজিদে ইতিকাফকালীন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামাতে আদায় করবেন। কখনো কোনো কারণে জামাত না হলে, নিজেই আজান–ইকামাত দিয়ে নামাজ আদায় করবেন। ওয়াক্তিয়া নামাজের জামাতের জন্য ইতিকাফ ছেড়ে অন্যত্র যাওয়া যাবে না। এ জন্যই সম্ভব হলে জামে মসজিদে ইতিকাফ করাই উত্তম।

ইতিকাফ কখন শুরু :

রমজানের ২০ তারিখ সূর্য অস্ত যাওয়ার কিছু আগে থেকে শুরু হয় এবং ঈদের চাঁদ দেখার সঙ্গে সঙ্গেই তা শেষ হয়ে যায়। ইতিকাফকারী পুরুষ রমজান মাসের ২০ তারিখ আছরের নামাজের পর সূর্যাস্তের আগে মসজিদে পৌঁছবেন। সূর্যাস্তের এক সেকেন্ড পরে ও যদি মসজিদে প্রবেশ করে তাহলে তার ইতিকাফ আদায় হবে না। কারণ সূর্যাস্তের আগেই প্রবেশ শর্ত।

মসজিদ থেকে বের হওয়া যাবে কখন :

ইতিকাফরত ব্যক্তি পেশাব-পায়খানার জন্য মসজিদের বাইরে গেলে আসা যাওয়ার পথে পথ চলতে চলতে সালাম আদান-প্রদান করতে পারবে। তদ্রুপ এসময় পথ চলতে চলতে কারো সাথে অল্পস্বল্প কথাও বলতে পারবে। এতে ইতিকাফের ক্ষতি হবে না।

যদি মসজিদে কোনো ইস্তেঞ্জাখানার ব্যবস্থা না থাকে এমতাবস্থায় বাসায় এসে জরুরত সারা ছাড়া কোনো বিকল্প না থাকে তাহলে বাসা-বাড়িতে এসে ইস্তিঞ্জা সেরে মসজিদে এসে অজু করাতে ইতিকাফ ভঙ্গ হবে না। কেননা ইস্তেঞ্জার জরুরুতে মসজিদের বাইরে যাওয়া জায়েয।

আর মসজিদের ইস্তেঞ্জাখানা না থাকলে এজন্য বাসা-বাড়িতে যাওয়াও জায়েয।

ইতিকাফ আদায়কারী ব্যক্তির খাবার মসজিদে পৌঁছে দেওয়ার মতো কেউ না থাকলে খাবার আনার জন্য বাসায় যেতে পারবে। এ কারণে ইতিকাফ ভাঙবে না। তবে খাবার আনার জন্য মসজিদ থেকে বের হয়ে অন্য কোনো কাজে বিলম্ব করা যাবে না।

অন্য কাজে অল্প সময় ব্যয় করলেও ইতিকাফ ভেঙে যাবে। অবশ্য ঘটনাক্রমে খাবার প্রস্তত না হলে সেজন্য অপেক্ষা করতে পারবে।

জানাযার উদ্দেশ্যে মসজিদ থেকে বের হলেও ইতিকাফ থাকে না। তাই ইতিকাফ অবস্থায় মসজিদের বাইরের জানাযার নামাযে শরিক হওয়া যাবে না। বের হলে সুন্নত ইতিকাফ নষ্ট হয়ে যাবে।

পারিশ্রমিক দ্বারা ইতিকাফ করানোর বিধান :

রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফের জন্য কোনো লোক পাওয়া না যাওয়ায় মহল্লাবাসী সকলে মিলে একজন দিনমজুরকে যদি ঠিক করে যে সে ইতিকাফ করবে এবং তাকে এর বিনিময়ে ঐ দিনগুলোতে কাজ করলে যে পরিমাণ মজুরি সে পেত তাকে তা দেওয়া হবে। এ ধরনের বিনিময় নিয়ে ইতিকাফ করা বা করানো সম্পূর্ণ নাজায়েয হবে।কারণ ইতিকাফ একটি ইবাদত। আর ইবাদতের বিনিময় দেওয়া-নেওয়া নাজায়েয।