ভূমিক্সঃ এভারতীয় উপমহাদেশে ইসলামী তাহযীব-তামাদ্দুন, সত্যিকারের ঈমান-আকীদা, শরিয়াত ও তরিকত আল্লাহর অলীদের মাধ্যমে প্রচার – প্রসার হয়েছে। তাঁদের বেলায়তের শীতল ছায়ায় অবস্থান করে অগণিত মানুষ ঈমান, নামাজ, রোজা, হজ্জ, যাকাত, মোরাকাবা-মোশাহাদা, জিকির-আযকার ইত্যাদির শিক্ষা পেয়েছে। ভারত, বাংলাদেশ ও মায়ানমারে যারা শরিয়ত-তরিকতের সঠিক দিক নির্দেশনার দ্বারা মানুষের মুর্দা কলবকে আল্লাহ তায়ালার জিকিরের তালিমের মাধ্যমে জিন্দা করেছেন, অন্ধকার কলবকে আল্লাহর ভয় ও রাসূলে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াল্লামের মুহব্বতের নূর দ্বারা নূরান্বিত তাঁদের মধ্যে কুতবুল ইরশাদ শাহ সূফী হাফেজ হামেদ হাসান আল্ভী আজমগড়ী রহঃ অন্যতম। তিনি আমাদের বাংলাদেশে “আজমগড়ী হযরত / হুজুর” হিসেবে পরিচিত এবং তাঁর জন্মস্থানে “বড় হাফেজ ছাহেব” হিসেবে পরিচিত।

জন্ম, জন্মস্থান ও নামঃ

ভারতের উত্তর প্রদেশের বিভাগীয় শহর আজগরের কুহন্ডায় ১৮৭১/৭২ খ্রিস্টাব্দে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বরকতময় নাম – হামেদ হাসান আল্ভী। ভারতের প্রসিদ্ধ জেলা “আজমগড়” তার জন্মস্থান হিসেবে তাঁকে আজমগড়ী হযরতও বলা হয়।

পিতৃ পরিচয় ও বংশ পরিচয়ঃ

তাঁর মুহতারাম পিতার নাম – হযরত মাওলানা শেখ মিয়া করিম বক্স রহঃ। কাকুরীর “আল্ভী” বংশের সাথে তাঁদের বংশ সম্পর্ক যুক্ত বলে তাঁদের নামের শেষে “আল্ভী” লেখা হয়। আজমগড়ী হযরতের পিতা হযরত মাওলানা শেখ মিয়া করিম বক্স রহঃ তৎকালীন চিশতিয়া তরিকতের একজন কামিল অলী ছিলেন এবং তিনি জরিপ বিভাগের সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। ঐ অঞ্চলের জমিদার পরিবার হিসেবে স্বীকৃত। তিনি কর্তব্য কাজে অবিভক্ত বাংলার উভয় অঞ্চল সফর করতেন। সাথে তরিকতের খেদমতও করে যেতেন। তিনি চট্টগ্রামেও সফর করেছেন অনেকবার। এমনকি কলকাতা চট্টগ্রাম হয়ে ইয়াঙ্গুন (রেঙ্গুন) ও আকিয়াব যাতায়াত করতেন। সেই ব্রিটিশ আমলে চট্টগ্রামের সাথে কক্সবাজার, আকিয়াব, ইয়াঙ্গুন ও কলকাতায় নিয়মিত জাহাজ চলাচল করত। ফলে আজমগড়ী হযরতের পিতা দাপ্তরিক কাজে চট্টগ্রাম হয়ে আকিয়াব, ইয়াঙ্গুন যাতায়াত করতেন। হযরত মাওলানা শেখ করিম বক্স (রহ.)’র পীর ছাহেব হচ্ছেন হযরত শেখ নেজাবত আলী (রহ.)। তিনি তরিকত প্রচারের এক সফরে তাঁর অন্যতম খলিফা হযরত মাওলানা শেখ করিম বক্স (রহ.)’র বাড়িতে তাশরীফ আনলে তথায় তিনি ইন্তেকাল করেন। ফলে হযরত মাওলানা শেখ করিম বক্স (রহ.) তাঁদের পারিবারিক কবরস্থানে তাঁর মহান পীর-মুর্শিদ হযরত শেখ নেজাবত আলী (রহ.) কে জানাজার পর দাফন করেন ।

শিক্ষা-দিক্ষা

ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি হাফেজে কুরআনও ছিলেন তিনি। ফলে ঐ অঞ্চলে তাঁকে বড়া/বড় হাফেজী হুজুর হিসেবে সম্মোধন করা হতো। এখনও তাঁদের বাড়ী “বড় হাফেজী হুজুরের বাড়ী” হিসেবে পরিচিত। তিনি তৎকালীন লেখা – পড়ার নিয়ম অনুযায়ী “হেদায়তুন্নাহু” পর্যন্ত লেখা – পড়া করেন। এমন অনেক আল্লাহর মাহবুব বান্দা আছেন, যারা জাহেরী ভাবে কোনো শিক্ষার্জন করেননি। কিন্তু এবাদত – রিয়াজত ও মোরাকাবা – মোশাহাদা মাধ্যমে আল্লাহ পদত্ত ইলমে লদুনীর জ্ঞানে জ্ঞানী ছিলেন। জাহেরী আলেমগণের এলম তাঁদের সামনে হার মেনে যায়।

পিতার ইন্তিকালঃ

হযরত শাহ সূফী হাফেজ হামেদ হাসান আল্ভী আজমগড়ী রহঃর পিতা হযরত মাওলানা শেখ মিয়া করিম বক্স রহঃ ১৮৮৭/৮৮ সালে ইন্তিকাল করেন।

হযরত আজমগড়ী রহঃর পীর-মুর্শিদের পরিচিতিঃ

কুতবুল এরশাদ শাহ সূফী হাফেজ হামেদ হাসান আল্ভী রহঃর পীর – মুর্শিদের নাম ইমামুত তরিকত হযরত শাহ সূফি সৈয়দ আব্দুল বারী রহঃ যিনি আজমগড়ী হযরতের পিতা হযরত মাওলানা শেখ মিয়া করিম বক্স রহঃর খলিফা ছিলেন। হযরত শেখ মিয়া করিম বক্স রহঃ সরকারী অফিসের কাজে বাংলার পশ্চিমাঞ্চল সফরকালে হযরত শাহ সূফী ছৈয়্যদ আবদুল বারী (রহ.)’র সাথে মোলাকাত হয়। ফলে হযরত ছৈয়দ আবদুল বারী (রহ.) চিশতিয়া সিলসিলায় দাখিল হন এবং পরবর্তীতে খেলাফত লাভ করেন। হযরত শাহ সূফী ছৈয়্যদ আবদুল বারী (রহ.) তাঁর মহান পীর হযরত মাওলানা শেখ করিম বক্স (রহ.)’র সাথে একাধিক বার আজমগড়ের কুহন্ডায় গমন করেছিলেন। হযরত শেখ করিম বক্স (রহ.)’র নিজের মাদারজাত অলি সন্তান হযরত হাফেজ হামেদ হাসান আলভীকে নিজের খলিফা হযরত শাহ সূফী ছৈয়্যদ আবদুল বারীর হাতে তরিকতে দাখিল করান। হযরত শেখ করিম বক্স (রহ.) ইন্তেকাল করলে তাঁকে তাঁদের পারিবারিক কবরস্থানে তাঁর মহান পীর হযরত শেখ নেজাবত আলী রহঃর নিকটে দাফন করা হয়। এদিকে আজমগড়ী হযরত তাঁর শ্রদ্ধাভাজন পীর হযরত শাহ সূফী ছৈয়্যদ আবদুল বারী রহঃ’র নিকট থেকে তরিকতের তালীম-ছবক নিতে থাকেন এবং পিতার অনুকরণে কলকাতা চট্টগ্রাম হয়ে আকিয়াব ইয়াঙ্গুন যাতায়াত করতেন। অপরদিকে, হযরত ছৈয়দ আবদুল বারী (রহ.) মুজাদেদ্দীয়া ত্বরীকায় শামসুল ওলামা হযরত শাহ সুফি গোলাম সালমানী (রহ.)’র হাতে তরিকতে দাখিল হন এবং খেলাফত লাভ করেন। পরবর্তীতে সাত তরিকার মহান ইমামগণ হযরত ছৈয়দ আবদুল বারী (রহ.) কে সরাসরি খেলাফত দানে ভূষিত করেন। তিনি আওলাদে রসূল (স.) ছিলেন। পিতা-মাতা উভয়ের দিক থেকে হাসানী ও হোসাইনী বংশের ছিলেন। তাঁর জন্ম ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে বলে জানতে পারা যায়। তাঁর পূর্ব পুরুষ পবিত্র আরব ভূমি থেকে দিল্লি হয়ে বাংলায় আসেন। তাঁর স্বাস্থ্য অতি দুর্বল থাকত। পেটের পীড়ায় ঘন ঘন আক্রান্ত হতেন। তিনি ৬ রমজান ১৩১৮ হিজরি ২৯ ডিসেম্বর ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে মাত্র ৪০ বছর বয়সে ইন্তেকাল করলে পশ্চিম বঙ্গের হুগলি জেলার বিখ্যাত বান্ডেল রেল স্টেশনের একদম নিকটে মাত্র ২/৩ শ’ মিটারের মধ্যে জামে মসজিদ সংলগ্ন কবরস্থানে দাফন করা হয়। তাঁর পার্শ্বে তাঁর পুণ্যবর্তী স্ত্রীও শায়িত।

হযরত আজমগড়ী রহঃর পীর-মুর্শিদের ইন্তিকালঃ

আজমগড়ী হযরত মায়ানমার থাকা অবস্থায় তাঁর শ্রদ্ধাভাজন পীর ছাহেব হযরত ছৈয়দ আবদুল বারী (রহ.) ইন্তেকাল করেন। ইন্তেকালের পূর্বে প্রকাশ্যে তাঁর অন্যতম যোগ্য দু’জন মুরিদ আজমগড়ী হযরত ও মাওলানা আবদুস সামাদ (রহ.) কে খেলাফত দিয়ে যান। আজমগড়ী হযরত আরাকানে শিক্ষকতা করতেন। মায়ানমার হল তাঁর পিতার কর্ম ও তরিকত উভয় দিকের যাতায়াতের অঞ্চল। তথায় তাঁর পিতার অসংখ্য মুরিদ রয়েছেন। নিজের পীর ছাহেব ছৈয়্যদ আবদুল বারী (রহ.)র অসুস্থতার সংবাদ শুনলে তিনি আকিয়াব থেকে সরাসরি বান্ডেল চলে আসেন। এরিমধ্যে সৈয়দ ছাহেব হুজুর ইন্তেকাল করেন। তথায় পৌঁছে জেয়ারতের পাশাপাশি তাঁর পীর ছাহেব কর্তৃক খেলাফত দানের কথা জানতে পারেন।

তখন থেকে আজমগড়ী হযরত নিজ বাসস্থান আজমগড়ের কুহন্ডা থেকে বাংলার বান্ডেল হয়ে চট্টগ্রাম শহরে আসতে থাকেন। চট্টগ্রাম থেকে আকিয়াব যাতায়াত করতেন সাগর পথে।

আজমগড়ী হযরত চট্টগ্রাম হয়ে আকিয়াবে বৎসরে এক বা একাধিক বার তরিকত প্রচার-প্রসারে সফরে আসতেন। এখানে উল্লেখ্য, হযরত শাহ সূফী ছৈয়্যদ আবদুল বারী (রহ) ইন্তেকালের পর তাঁর দাদা পীর হযরত শাহ সুফি মাওলানা গোলাম সালমানী ফুরফুরা (রহ.)’র সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলতেন।

দাদা পীর আজমগড়ী হযরতকে নির্দেশ দিয়ে ছিলেন, বৎসরে কম করে হলেও তিন মাস তরিকত প্রচার-প্রসারে সফর করতে। তিনি শারীরিক অসক্ষম থাকা অবস্থায়ও তা পালন করতেন।