রাব্বুল আলামীন পথহারা মানব জাতিকে সঠিক পথ প্রদর্শনের জন্য যুগে যুগে নবী-রাসূল আলাইহিমুস্ সালামগণকে পাঠিয়েছিলেন। নবী-রাসূলের আগমনের ধারা বন্ধ করে দিয়েছেন আখেরী রাসূল হুজুর সরওয়ারে কায়েনাত সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রেরণের মাধ্যমে। কিন্তু মানবজাতি কাকে দ্বীন-ধর্মের আলোকবর্তিকা হিসেবে গ্রহণ করবে? তাই হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন “আলিমগণ (যাদের কাছে শরীয়ত ও বেলায়তের ইলম রয়েছে) নবীগণের ওয়ারিশ বা উত্তরসূরী।” সুতরাং মানবজাতি তথা আমরা তাদের পথ, মত ও ছোহবত গ্রহণ করে প্রাপ্ত হবো আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পথ। এরূপ শরীয়ত ও তরীকতের তথা বেলায়তের একটি উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা ছিলেন কুতুবুল আলম হামিয়ে মাযহাব ও মিল্লাত উস্তাজুল আসাতেজা হযরতুলহাজ আল্লামা শাহ্সুফী মাওলানা সৈয়্যদ মীর আহমদ মুনিরী (রহ.)। যার ফয়েজ ও তাওয়াজ্জুহ গ্রহণ করে লক্ষ লক্ষ পথহারা মানুষ সঠিক আহলে সুন্নাত্ ওয়াল জামা’আতের অনুসারী হয়ে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রেমের বিভোর হয়েছেন। তাঁর অনেক খলিফা, মুরিদীন-মুহিব্বীন এখনও জিবীত আছেন। যাদের মুখ থেকে হযরত শাহ সাহেব রহঃ’র শরিয়ত – তরিকত, রিয়াজত, মুজাহাদা, তাকওয়া-ফরহেজগারী কিছু আমরা জেনেছি। আলোচ্য প্রবন্ধে তাঁর জীবন চরিত হতে কিয়দাংশ উপস্থাপনের প্রয়াস পেলাম।

হুজুর সম্পর্কে ভবিষ্যত বাণী:

  • গাউছুল আজম হযরত মাওলানা আহমদ উল্লাহ্ মাইজভান্ডারী (র:)’র সুযোগ্য খলিফা বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন আল্লামা সৈয়্যদ আব্দুল গণি কাঞ্চনপুরী (র:) একদা নানুপুর গ্রামে তাঁর জনৈক মুরিদ সৈয়্যদ মকবুল আহমদ (খলিফা) সাহেবের বাড়ীতে দাওয়াতে যাচ্ছিলেন। যখন তিনি মাওলানা মীর আহমদ মুনিরী (র:)’র বাড়ির দক্ষিণ পূর্ব পার্শ্বে কাঞ্চননগর রাস্তার মোড়ে আব্দুল গণি সরকার বাড়ীর নিকটবর্তী হলেন, তখন তিনি উত্তর পশ্চিমমুখী হয়ে স্বীয় অনুসারীদেরকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “ঐ সৈয়্যদ বাড়ীতে এমন একজন অলীর জন্ম হবে যার দ্বারা হাজার হাজার লোক আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পথ পাবে। তোমরা সেই অলীকে পেলে তাঁর সাথে সৎ ব্যবহার ও অনুসরণ করিও।
  • হুজুর কিবলা রহঃ এর বড় ভাই হযরত ছৈয়দ মোহাম্মদ আছমত উল্লাহ রহঃ একজন প্রসিদ্ধ অলী ও বুজুর্গ ছিলেন। হযরত মাওলানা মীর আহমদ মুনিরী রহঃ এর শৈশবকালে যখন তিনি ধুলাবালি নিয়ে খেলা করছিলেন তখন উক্ত বুজুর্গ সাহেব বলেছিলেন- ” মীর আহমদ একদিন এমন মহাপুরুষ হবে, যার দ্বারা হাজার হাজার জাহান্নামী জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাবে। কেয়ামত পর্যন্ত তাঁর দ্বারা আমাদের কবরস্থানে জেয়ারত চালু থাকবে। আমি ওয়ারীশহীন বিধায়, আমার ও আমার পূর্বপুরুষের জেয়ারতের জন্য এই জমিনখানা ( বর্তমান ভিটা ) তাকে দান করলাম।”

আর আল্লাহর মকবুল বান্দাগণ আধ্যাত্মিক দূরদৃষ্টির দ্বারা অবলোকন করে তাঁদের স্ব-স্ব মুরিদীন ও মুহিব্বীনদেরকে এভাবে অছিয়ত ও নছিহত করে যান। যাতে তাঁদের অবর্তমানে মুরিদীন ও মুহিব্বীনগণ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আদর্শের উপর অটল থাকতে পারেন।হযরত মাওলানা আব্দুল গণি কাঞ্চনপুরী (রহ:) এবং হযরত শাহ সাহেব রহঃ’র ভবিষ্যৎ বাণী অনুযায়ী ঐ সৈয়্যদ বাড়ীতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন কুতুবুল আলম হযরত শাহ্ সৈয়্যদ মীর আহমদ মুনিরী (র:)। যার পদাঙ্ক অনুসরণ করে ফটিকছড়ি, চট্টগ্রাম নয় শুধু; বাংলাদেশ অতিক্রম করে বার্মাতেও হাজার হাজার মানুষ শরিয়ত-তরিকত তথা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের অনুসারি হয়েছেন এখনও হচছেন। তিনি পরিশ্রম করে যে জান্নাতের বাগান সাজিয়েছেন। সে বাগানের দুর্লভ একটি ফুল হলো- আমার মহান মোর্শেদে আজম রাঙ্গামাটিয়া শফিকীয়া দরবার শরীফের মধ্যমনি রাহনুমায়ে শরিয়ত ও তরিকত, হাদীয়ে দ্বীনো মিল্লাত, উস্তাজুল আসাতেজা ফখরুল ওয়ায়েজীন ওয়াছ ছালেকীন হযরতুলহাজ্ব আল্লামা শাহ্ছুফী চৌধুরী মুহাম্মদ শফিকুল ইসলাম মুনিরী ছাহেব কিবলা (ম:জি:আ:)। যিনি হযরত শাহ্ সৈয়্যদ আল্লামা মীর আহমদ মুনিরী (র:) হতে খিলাফত প্রাপ্ত হয়ে লক্ষ লক্ষ পথহারা মানুষকে ইনসানে কামিল হওয়ার নির্দেশনা দিয়ে তাজকিয়া ও তাছফিয়া শিক্ষা দিচ্ছেন। আল্লাহুম্মা যিদ্ হায়াতাহু!

বংশ পরিচয়: কুতুবুল আলম হযরত শাহ্ মাওলানা সৈয়্যদ মীর আহমদ মুনিরী (রহ:) চট্টগ্রামের কাট্টলী থানার অধিবাসী কাজী সৈয়্যদ মাওলানা বদি উদ্দীন সাহেব এর বংশধর ছিলেন। তাঁর দাদা সৈয়্যদ মাওলানা আজিমুদ্দীন সাহেব কাট্টলী থেকে হিজরত করে ফটিকছড়ি উপজেলার উত্তর রাঙ্গামাটিয়া গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। তাঁর দাদাজানের ঔরশে সাতটি সন্তান জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁদের মধ্যে পুত্র সৈয়্যদ হাকিম উল্লাহ সাহেবের ঘরে দু’পুত্র সন্তান জন্ম লাভ করেন। তাঁরা হলেন সৈয়্যদ হাসান শরীফ ও সৈয়্যদ কাজী শরীফ। সৈয়্যদ কাজী শরীফ সাহেব এর ঔরশে জন্ম লাভ করেন কুতুবুল আলম হযরত শাহ্সুফী সৈয়্যদ মাওলানা মীর আহমদ মুনিরী (র:)।

জন্ম ও জন্মস্থানঃ এ মহান আল্লাহর অলী জন্ম সন সম্পর্কে জানা না গেলেও তাঁর জীবনী শরীফে লিখা হয়েছে তিনি ১৯৭৮ ইং সনে প্রায় ৬৫ বছর বয়সে ইন্তিকাল করেন। এ হিসাবে সম্ভবত: ১৯১৩ ইংরেজী সনের কোন এক সময় জন্মগ্রহণ করেন তিনি।

শিক্ষা দীক্ষা :তাঁর শিক্ষা জীবন নিজ গৃহে কোরআন শরীফ পাঠের মাধ্যমে শুরু হয়। তারপর ফটিকছড়ি জামেউল উলুম সিনিয়র (ডিগ্রী) মাদরাসায় ভর্তি হয়ে জমাতে হাফতুম (৮ম শ্রেণী) পাশ করে সীতাকুন্ডের দারোগারহাট মাদরাসায় ভর্তি হন। তারপর চট্টগ্রাম দারুল উলুম আলীয়া (এম.এ) মাদরাসায় ভর্তি হয়ে কৃতিত্বের সাথে ফাজিল পাশ করেন। ছাত্র হিসেবে তিনি ছিলেন মেধাবী, তেজস্বী, ধীশক্তি সম্পন্ন ও অধ্যবসায়ী। তাঁর প্রবল জ্ঞান পিপাসা তাঁকে পাঠ বহির্ভূত পুস্তকাবলী অধ্যয়নে উদ্বুদ্ধ করে তুলে। ফলে তিনি অর্জন করেন প্রচুর জ্ঞান ভান্ডার।

কর্মজীবন: হযরত শাহ্সুফী সৈয়্যদ মীর আহমদ মুনিরী (র:) তাহসীলে উলুম সমাপ্ত করার পর ১৯৫৮ সালে ফটিকছড়ি জামেউল উলুম সিনিয়র (ডিগ্রী) মাদরাসায় মুর্দারিস হিসেবে যোগদান করেন। সুদীর্ঘ ১৯ বছর যাবৎ তাঁর জ্ঞান ভান্ডার হতে জ্ঞান পিপাসু হাজার হাজার ছাত্রকে শিক্ষাদান করে গড়ে তোলেন অসংখ্য ওলামায়ে হক্কানী। তিনি ছিলেন একজন আদর্শবান শিক্ষক। এমন কি তাঁর জীবনী শরীফে দেখেছি, তিনি কিতাবের জটিল-কঠিন বিষয়কে ছাত্রদের সামনে অতি সহজ-সরল ভাবেই তুলে ধরতেন। তাই ছাত্ররা তাঁর পাঠ গ্রহণের প্রত্যাশায় সর্বদা আকাঙ্খিত থাকত। তাঁর অনেক ছাত্র এখনো জীবিত রয়েছেন। তারা তাঁর সম্পর্কে আরো ভাল করে জানেন।পরবর্তীতে তাঁর চরিত্র মাধুর্য্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে তৎকালীন মাদ্রাসার সুপারিনটেনডেন্ট মাওলানা আহমদ হোসেন সাহেব (রহ:)’র ইন্তিকালের পর মাদরাসার সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য স্থানীয় জনসাধারণ হযরত শাহ্সুফী মাওলানা সৈয়্যদ মীর আহমদ মুনিরী (র:) কেই মনোনীত করেন। আহলে সুন্নাহ্ ওয়াল জামাআতের মতাদর্শ অনুসারী আলেম ওলামা ও জনসাধারণ প্রত্যেকেই তাঁর কাছে আজীবন ঋণী হয়ে থাকবেন।

‘শাহ সাহেব’ খেতাবঃ উত্তর চট্টগ্রামে তিনি ঐ ব্যক্তি যাকে সবাই “শাহ সাহেব” বলত। এখনও ঐ নামে তিনি সবার কাছে পরিচিত ও সমাদৃত। এখনও অনেক মানুষ আছেন, যারা শাহ সাহেব রহঃ এর কথা বলতেই আহ! তিনি কী ধরনের অলী ছিলেন। যার মাহফিলের শুরুতে ” নাহমাদুহু ওয়া নুছল্লি ওয়া নুছল্লিমু আলা- হাবিবীহিল কারীম” এতটুকু বলতেই মাহফিলে কান্নার রোল জারী হয়ে যেত। রহমতুল্লাহি আলাইহি

মাদরাসা প্রতিষ্ঠা ও মাদরাসা প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতা: দ্বীন-ধর্ম প্রচার ও আকায়েদে আহলে সুন্নাহ্ প্রচার প্রসারের লক্ষ্যে তিনি ফটিকছড়ি জামেউল উলুম সিনিয়র (ডিগ্রী) মাদ্রাসার সার্বিক উন্নয়নের কাজে হাত দিয়ে সফলতার সাথে সমাধা করেন। এছাড়াও তিনি কতগুলো মাদরাসা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। তৎমধ্যে তাঁর নিজ বাড়ীতে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন- মুনিরুল কোরআন হাফেজীয়া মাদরাসা। মুরিদীন ও মুহিব্বীনদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেছেন -“তোমরা মাদরাসাকে ভালবাসলে আমাকে পাবে।” এছাড়া নানুপুর মাজহারুল উলুম গাউছিয়া সিনিয়র (ডিগ্রী) মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা আবু সায়ীদ তোফায়েল আহমদ রহঃ এ মাদরাসা উন্নয়নের কাজে হযরত শাহ্ সাহেব রহ:’র সহযোগিতা নিয়ে একে একটি পরিপূর্ণ মাদরাসায় রূপ দান করেন। প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা আবু সায়ীদ তোফায়েল আহমদ সাহেব এর ইন্তিকালের পর তাঁর একমাত্র পুত্র এবং হযরত শাহ্ সাহেব রহ:’র বড় জামাতা আলহাজ্ব মাওলানা মঈনুদ্দীন আহমদ রহঃ এ মাদরাসার সুপারিনটেনডেন্ট’র দায়িত্ব ভার গ্রহণ করেন। তিনি নিজ শ্বশুর হযরত শাহ্ সাহেব রহ:’র সহযোগিতা নিয়ে মাদরাসা পুরাতন ভিটা হতে স্থানান্তরিত করেন এবং এ মাদরাসাকে দাখিল পর্যায় হতে ফাযিল মাদরাসায় রূপান্তরিত করেন। এমন কি বর্তমানে মাদরাসার দ্বিতল ভবন, মসজিদ পুকুর, দোকান ও হেফজখানা ইত্যাদি মাদরাসার যাবতীয় কাজ আলহাজ্ব মাওলানা মঈনুদ্দীন আহমদ (রহ:) সমাপ্ত করেন। আল্লাহ্! প্রত্যেককেই জাযায়ে খায়ের দান করুন।অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মধ্যে পাইন্দং রহমতিয়া ফোরকানীয়া মাদরাসা, ধুরুং কে.এম. টেক ফোরকানীয়া মাদরাসা ও আজিমপুর ফোরকানীয়া মাদরাসা সহ অসংখ্য মসজিদ ও মাদরাসা প্রতিষ্ঠায় তাঁর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতা রয়েছে বলে তাঁর জীবনী শরীফে উল্লেখ আছে।

তরিকত জীবন :বাল্যকাল হতেই হযরত শাহ্ সাহেব (রহ:) ভাবুক ও গুরুগম্ভীর ছিলেন। শরীয়ত বিরোধী কার্যকলাপ গান-বাজনা ইত্যাদির ঘোর বিরোধীতা করতেন। যেমন সত্যের আলোকপাত-এ উল্লেখ আছে, “১৯৬৬ ইংরেজী সনে ফটিকছড়ি বিবিরহাট বাজারের কিছু সংখ্যক কুচক্রি লোকেরা এক যাত্রাগানের আয়োজন করেছিল। সে সময় বিশেষ করে মাদ্রাসার সুপারিনটেনডেন্ট মাওলানা আহমদ হোসেন সাহেব, মাওলানা কবির আহমদ জেহাদী সাহেব ও শাহ্ সাহেব কেবলা অন্যান্য ওলামাগণকে নিয়ে ঐ যাত্রাগানকে জোর পূর্বক বন্ধ করে দিলেন। তাই হুজুরদের সাথে তাদের বড় ধরণের মনোমালিন্য সৃষ্টি হয়। তারা রাত্রে এসে ফটিকছড়ি সিনিয়র মাদরাসার বাবুর্চিখানা জ্বালিয়ে দেয় এবং ওলামায়ে ক্বেরামগণকে মন্দ ব্যবহার করে। এতে আলেমগণ একত্রিত হয়ে তাদেরকে কুফরী ফতোয়া দিলেন। আলেমদের মধ্যে হুজুর কেবলা ঐ ব্যাপারে বেশী ভূমিকা রেখেছিলেন। হুজুর কেবলা কয়েকজন আলেমকে সাথে নিয়ে গানের মঞ্চে গিয়ে বাঁধা প্রদান করেন।”

এতে বুঝা যায়, হযরত শাহ্ মাওলানা সৈয়্যদ মীর আহমদ মুনিরী (র:) শরিয়ত বিরোধী কাজে কতই না কঠোর ছিলেন। বাল্যকাল হতে তিনি বুজুর্গদের মজলিশে বসে তাঁদের কথা-বার্তা শুনতে ভালবাসতেন। সঙ্গীরা তাকে “সুফী” বলে ডাকত। তখন তিনি ১০ম শ্রেণীর ছাত্র মাত্র। আত্মশুদ্ধি অর্জন করার নিমিত্তে একজন রাহবর তালাশ করত; তাঁর সম্মানিত উস্তাদ, চট্টগ্রাম দারুল উলুম আলীয়া (এম.এ) মাদরাসার তৎকালীন সময়ের মোফাচ্ছের চুনতীর হযরত শাহ্ সূফি নজীর আহমদ (র:)’র শরণাপন্ন হন এবং তাঁর নিকট হতে তরিকতের সবক গ্রহণ করেন। হযরত আল্লামা শাহ্ সৈয়্যদ মীর আহমদ মুনিরী (রহ:) চুনতীর হযরত শাহ্ নজীর আহমদ (রহ:) এর নিকট দশ সবক শেষ করে দায়েরা পর্যন্ত পৌঁছার পর তিনি ইন্তিকাল করেন। এতে হযরত শাহ্ সাহেব (রহ:) অত্যন্ত ব্যথিত হন। তরিকতের আরো উন্নতির প্রত্যাশায় কোথায় যাবেন এ চিন্তা ভাবনায় তিনি অস্থির হয়ে পড়েন। এমতাবস্থায় ভারতের আজম গড় হতে চট্টগ্রামে আগমন করেন হযরত শাহ্ নজীর আহমদ চুনতী (রহ:) ও সোলতানুল আউলিয়া হাফেজ মুনিরুদ্দীন হালিশহরী রহঃ’র মহামান্য পীর সাহেব কুতুবুল এরশাদ গউছে জামান হযরত হাফেজ হামেদ হাসান আলভী আজমগড়ী রহঃ। হযরত শাহ্ নজীর আহমদ চুনতী (র:) এর ইন্তিকালে ব্যথা অনুভব করতে পেরে তিনি তাঁকে এজাজত দিলেন যাতে তরিকতের অবশিষ্ট কাজ খাজায়ে বাঙ্গাল হাফেজ মুনিরুদ্দীন হালিশহরী (রহ:) হতে সমাপ্ত করেন। এজাজত পেয়ে তরিকতের অবশিষ্ট সবক তাঁর কাছে শেষ করার পর তার নিকট হতে খেলাফত লাভে ধন্য হন।

হযরত শাহ সাহেব রহঃ’র প্রথম পীর হযরত শাহ সূফি আল্লামা নজীর আহমদ চুনতী রহ’র সংক্ষিপ্ত পরিচিতিঃ যার তা’রিফ গাজীয়ে দ্বীনো মিল্লাত আল্লামা আজিজুল হক শেরে বাংলা (র:) দিওয়ানে আজিজ-এর ৫৩ পৃষ্ঠায় এভাবে করেছেন-

در مدح پيشواۓ عالماں مقتداۓ سالکاں محبوب سنياں قاتل وھبياں استاذ العلماء فخر الکملاء بدر الفضلاء پير مغاں ھادۓ زماں حضرت الحاج مولانا شاہ نذير احمد باشندہ چنوتی

ہے بينظير اند درميان عالماں و فاضلا + ماھر علم شريعت ھم طريقت بيگماں

از براۓ اہل سنت مدرسہ کردہ بنا + فيض جاری تاقيامت مانداز ذاتش بقا

رکن اعظم بود بھر اہلسنت بے گماں + زھر قاتل بود ليکن از براۓ وھبياں

হযরত শাহ সাহেব রহঃ’র দ্বিতীয় পীর সোলতানুল আউলিয়া হযরত শাহ সূফি সৈয়্যদ মুনিরুদ্দীন রহ’র সংক্ষিপ্ত পরিচিতিঃ

পীর ভক্তি : তাঁর জীবনী শরীফে আছে, হালিশহরে গমন কালে তিনি অত্যন্ত বিনয়ী ও নম্র হয়ে নিজেকে তুচ্ছরূপে গণ্য করে নিতেন। এমন কি, তিনি হালিশহরে যাবার সময় নুর আহমদ কন্ট্রাক্টর হতে একটা এক কাটা পাঞ্জাবী পরিধান করে জুতা ছাড়া খালি পায়ে হেঁটে যেতেন। এমন গুরু ও পীর ভক্তি খুবই বিরল। এতে করে হযরত সৈয়্যদ মীর আহমদ মুনিরী (রহ:) হযরত হালিশহরী (রহ:) হতে সঞ্চয় করলেন প্রাণঢালা ভালবাসা, পেলেন গভীর মহব্বত এবং তিনি হলেন হযরত হালিশহরী (র:) এর প্রধান খলিফা।একদিন হযরত হালিশহরী (র:) আপন মুরিদদেরকে মসজিদের মধ্যে নছিহত করে ছিলেন, হঠাৎ দাঁড়িয়ে হযরত শাহ্ সাহেব (রহ:) কে বললেন, “মীর আহমদ বদনাটা নিয়ে আমার সাথে আস। যেতে যেতে বর্তমান মাজার শরীফের দক্ষিণ দিকে যে তবলীগ মনজিল আছে, তা পশ্চিম পার্শ্বের চিকন রাস্তার দিয়ে কতদূর গিয়ে হযরত শাহ্ সাহেব (র:) কে বললেন- মীর আহমদ বদনা রাখ! আমি হাজত পূরণ করার জন্য আসিনি, আমার সামনে আস!! তোমার সাথে কথা আছে!!! যখন নিকটে গেলেন তখন হালিশহরী (রহ:) তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, মীর আহমদ! আমার সিনায় যা কিছু আছে আজকে তোমাকে দিয়ে দিলাম। তোমাকে পাহাড়ের গোড়ায় অন্ধ ও জাহেল লোকদেরকে হেদায়েত করে বেহেস্ত পৌঁছিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা দিয়ে দিলাম।” সত্যিই হযরত শাহ্ সাহেব (রহ:) এর মুরীদান পাহাড়ের গোড়ায় গোড়ায়- এমন কি বার্মার পাহাড়ী অঞ্চলে পর্যন্ত তাঁর রূহানী সন্তান বর্তমানেও আছে। হযরত শাহ্ মীর আহমদ মুনিরী (রহ:) হযরত হালিশহরী (রহ:) এর সিনা মোবারক হতে যে বেলায়তের এলম লাভ করেছিলেন, তিনি তা আমার মহান মোর্শেদে কিবলায়ে আজম (ম:জি:আ:) কে দান করে বলেছিলেন, “আমি তোমাকে দুনিয়া ও আখেরাতের সেক্রেটারী নিযুক্ত করলাম”। এখন তাঁর বেলায়তের ছায়া তলে এসে লক্ষ লক্ষ পথহারা যুবক, বৃদ্ধ, নারী ও পুরুষ সকলেই সঠিক আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের অনুসারী হয়ে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রেম-ভালবাসা অন্তরে নিয়ে দৈনিক ১১১১ বার দুরূদ শরীফ পড়ছেন। এ তরিকতের অনুসারীরা বাংলাদেশ, চীন, বার্মার মরুভূমি ও পাহাড়ের চূড়ায়, আরব আমিরাতে, আমেরিকায়, সাইপ্রাস এ পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম), ফাতেহায়ে ইয়াজদাহুম, খাজা গরীবে নেওয়াজ রহ:’র ফাতেহা, শোহাদায়ে কারবালার স্মরণে মাহফিল ও মিলাদ মাহফিল প্রতিনিয়ত আদায় করে যাচ্ছেন।

কতিপয় কারামতঃ ইমাম আজম আবু হানিফা রহ’র বিশ্ববিখ্যাত আকিদার কিতাব “আল ফিকহুল আকবর”, আল্লামা সা’দুদ্দিন তাফতাযানী রহ’র লিখিত “শরহু আকাইদুন নাসাফি” এবং ইমাম আবু জাফর তহাবী রহ’র “আকিদাতুত তহাবী” ইত্যাদি কিতাবে আছে- كرامة الاولياء حق অর্থাৎঅলিগণের কারামত সত্য। এমন কোনো অলি নেই যার কাছ থেকে কিছু না কিছু কারামত প্রকাশ পায়নি। নিম্নে কুতবুল আলম রাহনুয়ে শরিয়ত ও তরিকত হাদিয়ে দীনো মিল্লাত আল্লামা শাহ সূফি সৈয়্যদ মওলানা মীর আহমদ মুনিরী রহ’র কতিপয় কারামত উল্লাখ করা হল-

আখেরী নছিহত:কুতুবল আলম হযরতুলহাজ্ব আল্লামা শাহ্সুফী মাওলানা মীর আহমদ মুনিরী (র:) অন্তিমকালে ও শেষ বয়সে বেশ কিছু নছিহত করেছিলেন; তার কয়েকটি নিচে দেওয়া হলো-

১। কারো সাথে এখতেলাফ করবে না। কেউ কোনরূপ এখতেলাফ করতে চাইলে বা ঝগড়া জুড়ে দিলে নিজেকে ছোট মনে করে তার নিকট হতে সরে পড়বে। কোন প্রকার গর্ব করো না। গর্ব করা তরিকতপন্থী লোকের বরখেলাপ কাজ।

২। যে ব্যক্তি আল্লাহকে চিনেছে, তার নিকট কোন কিছু গোপন থাকে না।

৩। কারো গীবত (পরনিন্দা) করলে প্রথমে তার নিকট মাফ চাইবে। পরে আল্লাহ তায়ালার নিকট তওবা ও ক্ষমা প্রার্থনা করবে।

৪। যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে, দুনিয়ার যাবতীয় কিছু তাকে ভয় করে।

৫। মুসলমান ভাইকে অপমান ও অপদস্থ করলে তোমার যত ক্ষতি হবে, রাশি-রাশি পাপেও তোমার তত ক্ষতি হবে না।

বেছাল শরীফ: অন্তিম পীড়াকালীন সংকটময় মুহুর্তে হযরত শাহ্ সৈয়্যদ মীর আহমদ মুনিরী (রহ:) চট্টগ্রামের মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৬নং কেবিনে শয্যাশায়ী ছিলেন। ১৩৯৮ হিজরীর ৭ই রবিউল আউয়াল ১৯৭৮ ইং সনে ১৫ই ফেব্রুয়ারী রোজ বুধবার সন্ধ্যা ৬টার সময় তিনি উক্ত কেবিনে শায়িতাবস্থায় অগণিত মুরীদ, ভক্ত ও আত্মীয়-স্বজনকে শোক সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে প্রায় ৬৫ বছর বয়সে ইন্তিকাল করেন। (ইন্না লিল্লাহ ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজেউন) ইন্তিকালের পর ডা: আব্দুল ওহাব সাহেব হযরত শাহ্ সাহেব রহ:’র শরীরে ষ্টেথিস্কোপ দিয়ে দেখতে লাগলেন। অত:পর ডা: নুর নবী সাহেবকে লক্ষ্য করে বললেন “স্যার আমি অনেক লাশ দেখেছি; কিন্তু এরূপ লোক তো আমার হাতে পড়েনি। উনার মৃত দেহের যেখানে যন্ত্র রাখি, সেখান হতে আল্লাহ! আল্লাহ! শব্দ বের হচ্ছে। তাঁর খলিফাদের মধ্যে আমার মহান মোর্শেদে আজম (ম:জি:আ:) ও ধলই এর হযরতুলহাজ্ব আল্লামা মাওলানা মাহবুবুল আলম মুনিরী (রহ:) সহ আরো অনেক রয়েছেন। যাদের ব্যাপারে তিনি বলেছেন- “আমার খলিফাদের সাথে সম্পর্ক রাখলে তোমরা ফায়দা হাসিল করতে পারবে।”

এ অধমের অলীকুল শিরুমনী কুতবুল আলম উস্তাজুল উলামা ও ফুদালা হযরত শাহ্ সুফী সৈয়্যদ মীর আহমদ মুনিরী (রহ:) সম্পর্কে কিছু লিখার কোন যোগ্যতা নেই। আর তাঁর হায়াতে মোরাকাবার অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াবলী এ লেখা সংক্ষিপ্ত করণার্থে উল্লেখ করা হয় নি। হে আল্লাহ! এ লেখা-লিখনী আমার নাজাতের জরিয়া হিসেবে কবুল করুন। আমিন! বেহুরমতে সায়্যিদিল মুরসালিন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম

তথ্যপুঞ্জি:

১। জীবনী শরীফ হযরতুলহাজ্ব আল্লামা শাহ্সুফী মাওলানা সৈয়্যদ মীর আহমদ মুনিরী (র:)

২। সত্যের আলোকপাত।

৩। সংগঠন পরিচিতি।

৪। আত্ তোফায়েল (নানুপুর মাজহারুল উলুম গাউছিয়া সিনিয়র (ডিগ্রী) মাদ্রাসা বার্ষিক মাহফিল স্মরণিকা)