ইসলাম তাসাউফ তথা শরিয়তর পাশাপাশি তরিকত, হাকিকত ও মা’রিফত অর্জন করার জন্য পীর – মুর্শিদের নিকট বাইয়াত গ্রহণ করা একটি অত্যাবশ্যকীয় বিষয় যা কুরআন, সুন্নাহ, ইজমা ও কিয়াস দ্বারা প্রমাণিত।

ইসলামে তাসাউফ তথা শরীয়তের পাশাপাশি তরীকত হাকীকত ও মারেফাত অর্জন এবং সে জন্য পীর-মুর্শিদের নিকট বাইয়া’ত গ্রহণ একটি অত্যাবশকীয় বিষয় যা কোরআন হাদীছ ইজমা ও ক্বিয়াস দ্বারা সাব্যস্ত।
মহান আল্লাহ কোরআনুল কারীমে বলেন- لقد من الله على المؤمنين اذ بعث فيهم رسولا من انفسهم يتلوا عليهم أيته يزكيهم و يعلمهم الكتب والحكمة و ان كانوا من قبل لفى ضلل مبين অর্থ্যাৎ মু’মিনদের প্রতি আল্লাহ পাকের বড়ই ইহসান যে তাদের মধ্যে হতে তাদের জন্য একজন রসূল প্রেরণ করেছেন, তিনি আল্লাহ পাকের আয়াতগুলো তেলায়াত করে শুনাবেন তাদেরকে তাজকিয়া (পরিশুদ্ধ) করবেন এবং কিতাব ও হিকমত (আধ্যাত্মিক) জ্ঞান শিক্ষা দিবেন। যদিও তারা পূর্বে হেদায়েত প্রাপ্ত ছিল না।
(সূরা আলে এমরান,১৬৪)

অনুরূপ সুরা বাকারা’র ১২৯ ও ১৫১ নং আয়াত শরীফে উপরোক্ত আয়াত শরীফের সমর্থবোধক আয়াতে কারীমা উল্লেখ আছে। মূলতঃ উল্লেখিত আয়াত শরীফে বিশেষভাবে চারটি বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে তন্মধ্যে- আয়াত শরীফ তেলাওয়াত করে শুনানো এবং কিতাবহিকমত শিক্ষা দেয়া এ তিনটি বিষয় হচ্ছে এলমে জাহির বা ইলমে ফিকাহ। যা এবাদাতে জাহের বা দ্বীনের যাবতীয় বাহ্যিক হুকুম আহকাম পালন করার জন্য ও দৈনন্দিক জীবন যাপনের জন্য হালাল কামাই করার জন্য প্রয়োজন। আর চতুর্থ হচ্ছে- তাজকিয়া অর্থ্যাৎ অন্তর পরিশুদ্ধ করার মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি লাভ করা। আর এটা ইলমে মারেফতের অন্তর্ভূক্ত।
মুফাসসিরীনে কিরামগণ “ইউযাক্কীহিম” এর ব্যাখ্যায় প্রসি্দ্ধ তাফসীরের কিতাব যেমন তাফসীরে জালালাইন-কামালাইন, বায়হাকী, ইবনে কাছীর, রুহুল বয়ান, তাফসীরে মাযহারী, মারেফুল কোরআন সহ আরও অনেক তাফসীরে তাজকিয়ায়ে ক্বলব বা অন্তঃকরন পরিশুদ্ধ করাকে ফরজ বলেছেন এবং তজ্জন্যে এলমে তাসাউফ অর্জন করাও ফরজ বলেছেন। এ প্রসঙ্গে বিখ্যাত মুফাসসিরে ফকিহুল উম্মত হযরত মাওলানা শায়খ ছানাউল্লাহ পানি পথি (রহঃ) তাঁর বিখ্যাত তাফসীর গ্রন্থ ‘তাফসীরে মাযহারী’তে উল্লেখ করেন, যে সকল লোক ইলমে লা-দুন্নী বা ইলমে তাছাউফ হাছিল করে তাদেরকে সূফি বলে। তিনি ইলমে তাছাউফ অর্জন করা ফরজ আইন বলেছেন। কেননা ইলমে তাছাউফ মনকে বা অন্তঃকরণকে গায়রুল্লাহ হতে ফিরিয়ে আল্লাহ পাকের দিকে রুজু করে দেয়। সর্বদা আল্লাহ পাকের হুজুরী পয়দা করে দেয় এবং ক্বলব্ বা মন থেকে বদ খাছলত সমূহ দূর করে নেক খাছলত সমূহ পয়দা করে অন্তরকে পরিশুদ্ধ করে দেয়।

আত্মশুদ্ধি অর্জনের জন্য ইলমে তাসাউফ যে ফরজ এ প্রসঙ্গে আফজালুল মুফাসসিরীন আল্লামা হযরত ইসমাঈল হাক্কি (রহঃ) তাঁর ‘তাফসীরে রুহুল বয়ানে’ উল্লেখ করেন যে, দ্বিতীয় প্রকার ইলেম হচ্ছে ইলমে তাছাউফ যা ক্বলব বা অন্তরের সাথে সংশ্লিষ্ট। এ ইলম অর্জন করা প্রত্যেক মু’মিনের জন্য ফরজ।
এলমে তাছাউফ অর্জন করা ফরজ হওয়া সম্পর্কে ‘জামিউল উসুল’ নামক কিতাবে উল্লেখ আছে যে, এলমে তাছাউফ যা বদ খাছলত সমূহ হতে নাজাত বা মুক্তি পাওয়ার একমাত্র মাধ্যম। পক্ষান্তরে আল্লাহ প্রাপ্তি, রিপু বিনাশ ও সংযম শিক্ষার একমাত্র পথ। এই জন্য ইলমে তাছাউফ শিক্ষা করা ফরজে আইন।
মূলতঃ শরীয়ত, তরীকত, হাকীকত ও মারেফত এ সব প্রত্যেকটিই কোরআন সুন্নাহ সম্মত এবং তা মানা ও বিশ্বাস করে কায্যে পরিণত করে কোরআন সুন্নাহ’রই নির্দেশের অর্ন্তভূক্ত।

আল্লাহ পাক এরশাদ করেন- لكل جعلنا منكم شرعة و منهاجا
অর্থ্যাৎ আমি তোমাদের প্রত্যেকের জন্য একটি জীবন বিধান বা শরীয়ত অপরটি তরীকত সম্পর্কিত বিশেষ পথ নির্ধারন করে দিয়েছি। (সূরা মায়েদা, আয়াত ৪৮)

আল্লাহ তাঁর কালাম পাকে আরও এরশাদ করেন- وان لواستقاموا على الطريقة
অর্থাৎ তারা যদি তরীকতে (সঠিক পথে) কায়েম থাকতো। অতএব তরীকত শব্দটি কোরআন শরীফে রয়েছে। (সূরা জ্বিন, আয়াত ১৬)।

আর হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে- الشَّريعةٌ شَجرَةٌ وَ الطَّرِيقَةُ اَغصَانُهَا وَ المَعرِفَةُ اَورَقُهَا وَ الحَقِيقَةُ ثَمَرُهَا
অর্থাৎ শরীয়ত একটি বৃক্ষ স্বরূপ তরীকত তার শাখা প্রশাখা মারেফাত তার পাতা এবং হাকীকত তার ফল ।(সিরুলুল আসরার)

হাদীস শরীফে আরও এরশাদ হয়েছে- اَلشَّرِيعَةُ اَقوَالِى وَ الطَّرِقَةُ اَفعَالِى وَالحَقِيقَةُ اَحوَالِى وَالمَعرِيفَةُ اَسرَارِى
অর্থাৎ শরীয়ত হলো আমার কথা সমূহ (আদেশ-নিষেধ), তরীকত হলো আমার কাজ সমূহ (আমল), হাকীকত হলো আমার গুপ্ত রহস্য। (ফেরদাউস)
উল্লেখ্য যে, উক্ত শিক্ষা বা এলমে তাছাউফ অর্জন করার ও এছলাহে নাফস বা আত্মশুদ্ধি লাভ করার একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে কোন কামেলে-মোকাম্মেল পীর-মুর্শিদের নিকট বাইয়া’ত হওয়া যিনি ফয়েজ দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন। এখন প্রশ্ন হলো এছলাহে নাফস বা আত্মশুদ্ধি লাভ করা যদি ফরজ হয় আর তা লাভ করার মাধ্যমে বাইয়া’ত হয় তবে বাইয়া’ত হওয়া নাজায়েজ হয় কি করে?
তরীকত যথাযথ ভাবে পালন করতে হলে দ্বীনে এলেম অর্জন করতে হবে যা ফরজ।
এ এলেম দু’প্রকার-
১) ইলমে ফিকাহ
২) ইলমে তাছাউফ।
ইলমে ফিকাহ ইলমে ফিকাহ দ্বারা এবাদাতে জাহেরা সম্পর্কে জ্ঞান লাভ হয়। ইলমে তাছাউফ যার দ্বারা এবাদাতে বাতেন বা আভ্যন্তরীন অবস্থা পরিশুদ্ধ হয়ে ইখলাছ অর্জিত হয়ে।

এ মর্মে হাদীছ শরীফে এরশাদ হয়েছে- عن الحسن رضى الله عنه قال العلم علمان فعلم فى القلب فذاك العلم النافع و علم على للسان فذالك حجة الله غز و جل على ابن ادمঅর্থাৎ- হযরত হাসান রাঃ থেকে বর্ণিত,তিনি বলেন,রাসুলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেছেন:
এলেম দু’প্রকার (১) ক্বালবী এলেম। এটা হলো উপকারী এলেম। (২) লিসানী বা জবানী এলেম। এটা হলো আল্লাহ পাকের পক্ষ হতে আদম সন্তানদের প্রতি দলীল স্বরূপ।(মিশকাত শরীফ)

আর এ হাদীসের ব্যাখ্যায় মালিকী মজহাবের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম, ইমামুল আইম্মা রঈসুল মুহাদ্দিসীন ফখরুল ফুকাহা শায়খুল উলামা হযরত ইমাম মালিক (রহঃ) বলেন– مَن تَفَقَّهَ وَ لَم يَتَصَوَّفَ فَقَد تَفَسَّقَ وَ مَن تَصَوَّفَ وَ لَم يَتَفَقَّهَ فَقَد تَزَندَقَ وَ مَن جَمَعَ بَينَهُمَا فَقَد تَحضقَّقَ অর্থাৎ যে ব্যক্তি এলেম ফিকাহ (জবানী এলেম) অর্জন করলো কিন্তু এলেম তাছাউফ (ক্বালবী) এলেম অর্জন করলো না সে ব্যক্তি ফাসিক। আর যে ব্যক্তি ইলমে তাছাউফের দাবী করে কিন্তু শরীয়ত স্বীকার করেনা সে ব্যক্তি যিন্দীক (কাফের) আর যে ব্যক্তি উভয় প্রকার এলেম অর্জন করলো সে ব্যক্তি মুহাক্কিক তথা মু’মিনে কামেল। (মিরকাত, কিতাবুল ইলম)

অর্থ্যাৎ এলমে ফিকাহ ও এলমে তাছাউফ উভয় প্রকার এলেম অর্জন করতঃ দ্বীনের উপর সঠিকভাবে চলার চেষ্টা করা প্রত্যেকের জন্য ফরজ। বর্তমান মুসলমানের কাছে আসল সত্য জিনিস বা শিক্ষা না থাকাতে মানুষ প্রকৃত মু’মিন হতে পারছে না। কেবল মাত্র ক্বলব নামক অমূল্য রত্নটা হস্তগত করতে জীবনের সব সময়ই চলে যায় তবে মানুষ খাঁটি ঈমানদার হবে কবে। এ জন্য আমরা চিন্তা ফিকির করি না। তরীকতের এমন সরল সহজ পথ অবলম্বন করা দরকার যাতে খুবই অল্প সময়ের মধ্যে উক্ত নেয়ামত পেতে সক্ষম হয়। উল্লেখ্য যে, উক্ত নেয়ামত বা এলমে তাছাউফ অর্জন করার ও এছলাহে নফস বা আত্মশুদ্ধি লাভ করার একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে কোন কামেলে-মোকাম্মেল পীর-মুর্শিদের কাছে বাইয়া’ত হওয়া। এখন প্রশ্ন হলো তাজকিয়ায়ে নাফস বা আত্মশুদ্ধি লাভ করা যদি ফরজ হয় আর তা লাভ করার মাধ্যম বাইয়া’ত হয় তবে বাইয়া’ত হওয়া নাজায়েজ হয় কি করে? কেননা উছুলই রয়েছে যে আমলের দ্বারা ফরজ পূর্ণ হয় এবং সেই ফজরকে পূর্ণ করার জন্য সে আমল করাও ফরজ। উদাহরণ দিলে বুঝতে পারবেন যেমন এ প্রসঙ্গে “দুররুল মুখতার” কিতাবে উল্লেখ আছে, যে আমল ব্যতীত ফরজ পূর্ণ হয় না বা আদায় হয় না সে ফরজ আদায় করার জন্য সে আমলটাও ফরজ। যেমন উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় নামাজ আদায় করা ফরজ। আর এ নামাজ আদায় হওয়ার একটি শর্ত হচ্ছে পবিত্রতা অর্জন করা অর্থ্যাৎ ওজু। যখনই কেহ নামাজ আদায় করবে তখনই তার জন্য ওযু করা ফরজ হয়ে যাবে। যেহেতু ওজু ছাড়া নামাজ হবে না ঠিক তদ্রুপই এলমে তাছাউফ অর্জন করা ফরজ। আর বাইয়া’ত হওয়াও ফরজ। আর হাদীস শরীফে ভাষায় এ ধরণের ফরজ সমূহকে অতিরিক্ত ফরজ বলে গন্য করা হয়েছে। কাজেই উক্ত হাদিসে বর্ণিত অতিরিক্ত ফরজের অন্তর্ভূক্ত হচ্ছে মাজহাব মানা, বাইয়া’ত হওয়া ইত্যাদি।
মূলতঃ পীর-মুর্শিদের নিকট বাইয়া’ত হতে হবে। এটা মহান আল্লাহ পাকের কালামে অসংখ্যা আয়াত দ্বারাই প্রমানিত। যদি এখন আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন মহাজ্ঞানী ব্যক্তিবর্গগণ নিজেদের স্বার্থ অক্ষুন্ন রাখার জন্য না মানেন তবে কার কি বলার আছে। তাদেরকে যতই বুঝানো হউক না কেন কিছুতেই তারা বুঝার চেষ্টা করবে না। বা বুঝতে সক্ষম হয় না। তাদের ক্বালবে সীল মোহর মারা আছে।

সূফীকুল শিরোমনি আল্লামা জালাল উদ্দিন রুমী (রহঃ) বলেন-
‘ইলমে জাহের হাম চুঁ মসকা, ইলমে বাতেন হাম চুঁ শীর
কায় বুয়াদে বে শীরে মসকা, কায় বুয়াদে বেপীরে পীর’।
অর্থাৎ ইলমে জাহের জান দুধের মেছাল আর বাতেন জান মাখনের মেছাল, দুধ ছাড়া মাখন কিভাবে হয় আর পীরের আনুগত্য ছাড়া পীর কিভাবে হয়।
(মসনবী শরীফ)

এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক তাঁর পবিত্র কালামে এরশাদ করেন- ﻳَﺎ ﺃَﻳُّﻬَﺎ ﺍﻟَّﺬِﻳﻦَ ﺁَﻣَﻨُﻮﺍ ﺍﺗَّﻘُﻮﺍ ﺍﻟﻠَّﻪَ ﻭَﻛُﻮﻧُﻮﺍ ﻣَﻊَ ﺍﻟﺼَّﺎﺩِﻗِﻴﻦَ
অর্থ্যাৎ “হে ঈমানদারগন! তোমরা আল্লাহ পাককে ভয় কর, আর ছাদেকীনদের সঙ্গী হও” (সূরা তওবা,১১৯)।
এ আয়াত পাকে আল্লাহ পাক মূলতঃ পীর-মাশায়েখগণের সঙ্গী বা সোহবত এখতিয়ার করার কথা বলেছন। কারণ হক্কানী মুর্শিদগণই হাকীকি ছাদেকীন।
আল্লাহ তায়ালা কোরআন শরীফের প্রথম সূরাতেই শিখিয়ে দিচ্ছেন– ﺍﻫْﺪِﻧَﺎ ﺍﻟﺼِّﺮَﺍﻁَ ﺍﻟْﻤُﺴْﺘَﻘِﻴﻢَ ﺻِﺮَﺍﻁَ ﺍﻟَّﺬِﻳﻦَ ﺃَﻧْﻌَﻤْﺖَ ﻋَﻠَﻴْﻬِﻢْ
অর্থাৎ আমাদের সরল সঠিক পথ [সীরাতে মুস্তাকিম] দেখাও। তাঁদের পথ যাঁদেরকে তুমি নিয়া’মত দান করেছো। (সূরা ফাতিহা)
সূরায়ে ফাতিহায় মহান রাব্বুল আলামীন তাঁর নিয়ামত প্রাপ্ত বান্দারা যে পথে চলেছেন সেটাকে সাব্যস্ত করেছেন সীরাতে মুস্তাকিম।
আর তাঁর নিয়ামত প্রাপ্ত বান্দারা হলেন- ﺍﻟَّﺬِﻳﻦَ ﺃَﻧْﻌَﻢَ ﺍﻟﻠَّﻪُ ﻋَﻠَﻴْﻬِﻢْ ﻣِﻦَ ﺍﻟﻨَّﺒِﻴِّﻴﻦَ ﻭَﺍﻟﺼِّﺪِّﻳﻘِﻴﻦَ ﻭَﺍﻟﺸُّﻬَﺪَﺍﺀِ ﻭَﺍﻟﺼَّﺎﻟِﺤِﻴﻦَ
অর্থাৎ যাদের উপর আল্লাহ তা’আলা নিয়ামত দিয়েছেন, তারা হলেন নবীগণ, সিদ্দীকগণ, শহীদগণ, ও নেককার বান্দাগণ।(সূরা নিসা-৬৯)
এ দু’আয়াত একথাই প্রমাণ করছে যে, নিয়ামত প্রাপ্ত বান্দা হলেন নবীগণ, সিদ্দীকগণ, শহীদগণ, আর নেককারগণ তথা আল্লাহ’র অলীগণ।যাঁদের শানে আল্লাহ্‌ নিজেই ঘোষনা দেন- ألاَ اِنَّ اَولِياَء اللهِ لاَ خَوفٌ عَلَيهِم وَلَاهُم يَحزَنُون
অর্থাৎ সাবধান! নিশ্চয়ই আল্লাহ’র অলী বা বন্ধুগণের কোন ভয় নেই এবং তাঁদের কোন চিন্তা-পেরেশানী নেই। (সূরা ইউনূস-৬২)
আর তাঁদের পথই সরল সঠিক তথা সীরাতে মুস্তাকিম। অর্থাৎ তাঁদের অনুসরণ করলেই সীরাতে মুস্তাকিমের উপর চলা হয়ে যাবে। যেহেতু আমরা নবী দেখিনি, দেখিনি সিদ্দীকগণও, দেখিনি শহীদদের। তাই আমাদের সাধারণ মানুষদের কুরআন সুন্নাহ থেকে বের করে সীরাতে মুস্তাকিমের উপর চলার চেয়ে একজন পূর্ণ শরীয়ত-তরূকতপন্থী হক্কানী বুযুর্গের অনুসরণ করার দ্বারা সীরাতে মুস্তাকিমের উপর চলাটা হবে সবচেয়ে সহজ। আর একজন শরীয়ত সম্পর্কে প্রাজ্ঞ আল্লাহ ওয়ালা ব্যক্তির সাহচর্য গ্রহণ করার নামই হল পীর-মুরিদী বা তাসাউফ অর্জন ও বাইয়া’ত গ্রহণ।
আল্লাহ পাক তাঁর পাক কালামে আরো এরশাদ করেন- يا ايها الذين امنوا وابتغوا اليه الوسيلةَ وَ جَاهِدُوا فِى سَبِيلِهَ لَعَلَّكُم تُفلِحُون অর্থ্যাৎ “হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহপাককে ভয় কর, আর তাঁর সন্তষ্টি লাভের জন্য উছিলা গ্রহণ কর। (সুরা মায়িদা, আয়াত-৩৫)
মুফাসসিরীনগণ বলেন- উল্লেখিত আয়াত শরীফে বর্ণিত উছিলা দ্বারা তরীকতের মাশায়েখগণকে বুঝানো হয়েছে। যেমন তাফসীরে রুহুল বয়ানে উক্ত আয়তের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে-‘আল ওয়াসলু লা ইয়াহছিলু ইল্লা বিল উছিলাতে ওয়াহিয়া ওলামায়ে মুহাক্কেকীনা ওয়া মাশায়েখুত তরিকত’ অর্থাৎ উক্ত আয়াতে উছিলা ছাড়া উদ্দেশ্যকে (আল্লাহ্‌কে) লাভ করা যাবেনা, আর সে উছিলা হলো মুহাক্কীক আলেম বা যিনি তরীকতের শায়খ বা পীর। যদিও অনেকে নামাজ রোজা হজ্ব যাকাত দান সদকা জিহাদ ইত্যাদিকে উছিলা বলে উল্লেখ করেছে। কিন্তু হাকিকতে পীরগণই হচ্ছেন প্রধান ও শ্রেষ্ঠতম উছিলা। কারণ পীর-মাশায়েখগণের নিকট বাইয়া’ত হওয়া ব্যতীত তাজকিয়া নাফস বা আত্মশুদ্ধি অর্জিত হয় না। আর আত্মশুদ্ধি ব্যতীত নামাজ রোজা হজ্জ যাকাত জিহাদ তাবলীগ কোন কিছুই আল্লাহ পাকের দরবারে কবুল হয় না বা নাজাতের উছিলা হয় না। তাই দেখা যাবে অনেক লোক নামাজ রোজা হজ্ব যাকাত দান ছদকা জিহাদ তাবলীগ করে এক লাফে জাহান্নামে যাবে।

যেমন আল্লাহ পাক বলেন, فويل للمصلين অর্থ মুসুল্লীদের জন্য জাহান্নাম। (সূরা মাউন)। কোন মুসুল্লী জাহান্নামে যাবে? যে মুছল্লী তাজকিয়ায়ে নাফসের মাধ্যমে অন্তর থেকে রিয়া দূর করে “ইখলাছ” হাছেল করেনি। তাই সে মানুষকে দেখানোর জন্য নামাজ আদায় করছে। আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টির জন্য নামাজ আদায় করেনি। আল্লাহ বলেন– الذين هم عن صلاةهم ساهون অর্থ তারা ঐ নামাজি যারা রিয়ার সহিত নামাজ আদায় করেছে। (সূরা-মাউন)

মুসলিম শরীফের ছহীহ হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে কেয়ামতের দিন শহীদ, দানশীল ও দ্বীন প্রচারকারী আলেম এ তিন প্রকার লোক থেকে কিছু লোককে সর্ব প্রথম জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। যে আলেম বলে থাকে কোরআন শরীফে বর্ণিত উছিলা হচ্ছে নামাজ, রোজা, হজ্ব, যাকাত ও জিহাদ ইত্যাদি। তাদের কাছে প্রশ্ন, তাহলে নামাজ আদায় করে, জিহাদ করে, দান করে এবং এলম অর্জন করে খেদমত করেও বান্দা জাহান্নামে যাবে কেন? কেনো উক্ত আমল সমূহ তার জন্য নাযাতের উছিলা হলো না? নিশ্চয়ই আপনারা বলবেন তাদের এখলাছ ছিল না। কেন এখলাছ ছিল না? তারা তাজকিয়ায়ে নফস বা আত্মশুদ্ধি লাভ করতঃ এখলাছ অর্জন করেনি। তা’হলে বুঝা গেল, পীর-মাশায়খগণ হচ্ছেন প্রধান ও শ্রেষ্টতম উছিলা। তথা উছিলা সমূহের উছিলা। কারণ তাদের কাছে বাইয়া’ত হওয়ার উছিলাতেই এছলাহ লাভ হয়। এখলাছ অর্জিত হয়। যার ফলে নামাজ, রোজ্‌ জিহাদ, দান ও খয়রাত কবুল হয়। নাজাতের উছিলা হয়।
কামেল পীর-মুর্শিদের গুরুত্ব সম্পর্কে আল্লাহ পাক এরশাদ করেন- من يهد الله فهو المهتد و منيضلل فلن تجد له وليا مرشدا
অর্থ্যাৎ যে ব্যক্তি হেদায়েত চায় আল্লাহ পাক তাকে হেদায়ত দেন আর যে ব্যক্তি গোমরাহীর মধ্যে দৃঢ় থাকে সে কখনও অলিয়ে কামেল মুর্শিদ খুঁজে পাবে না । (সূরা-কাহাফ,১৭)
উক্ত আয়াত শরীফের দ্বারা মূলতঃ এটাই বুঝানো হয়েছে যে ব্যক্তি কোন কামেল মোকাম্মেল পীর সাহেবদের নিকট বাইয়া’ত হয়নি সে ব্যক্তি গোমরাহ।
আল্লাহ্‌ পাক আরও মুর্শিদের আনুগত্যের বিষয়ে এরশাদ করে- أَطِيعُوا الله وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِى الآَمرِ مِنكُم
অর্থাৎ আনুগত্য কর আল্লাহ’র, আনুগত্য কর রাসূলের এবং যারা তোমাদের মধ্যে হুকুমদাতা। (সূরা নিসা, ৫৯)

উক্ত আয়াতে কারীমায় ‘ তোমাদের মধ্যে যারা হুকুমদাতা (উলিল আমর)’ দ্বারা শরীয়ত ও তরীকতের আলেমকে বুঝানো হয়েছে। এটাই বিশুদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য মত।
আল্লাহ পাক ঘোষণা করেন- يوم ندعوا كل اناس بامامهم অর্থাৎ, সেই দিন আমি প্রত্যেক দলকে তাদের ইমামের (শায়খের) নামে আহব্বান করব।(সূরা বনি ইসরাঈল)
এই আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসীরে “আ’রায়েসুল বয়ান” এ উল্লেখ রয়েছে, “ওয়া ইয়াদ’উল মুরীদিনা বে আসমায়ে মাশায়েখেহীম” । অর্থাৎ হাশরের দিন প্রত্যেক মুরীদকে ডাকা হবে যার যার শায়খ বা পীরের নামে। তাই পীরের দলভুক্ত হয়ে আল্লাহ’র দরবারে হাজিরা দিতে হবে।

বাইয়াত:

বাইয়া’ত” শব্দের উৎপত্তি হয়েছে, “বাইয়ু’ন” শব্দ থেকে।“বাইয়ু’ন” শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে “ক্রয়-বিক্রয়”। এখানে এই “ক্রয়-বিক্রয়” মানে হচ্ছে আমার আমিত্বকে আল্লাহর রাহে রাসূল (দঃ) বা নায়েবে রাসূলের নিকট কোরবান করে দিলাম,বিলিন করে দিলাম,বিক্রি করে দিলাম। আমার আমিত্ব, আমার যত অহংকার আছে, অহমিকা আছে, আমি আমি যত ভাব আছে সমস্ত কিছু আল্লাহর রাসূল (দঃ) বা নায়েবে রাসূলের কাছে আল্লাহর রাহে সম্পূর্ণরূপে উৎসর্গ করে দেয়া, কোরবান করে দেয়া ,বিক্রি করে দেয়া এবং পক্ষান্তরে রাসূলের(সঃ) কাছ থেকে কোরআন সুন্না ভিত্তিক জীবন ব্যবস্থা খরিদ করে, সমস্ত উপাসনার মালিক আল্লাহ, এবাদতের মালিক আল্লাহ, কুল মুখলুকাতের মালিক আল্লাহ, এই দৃঢ় ঈমানে ঈমানদার হয়ে যাওয়া, এটাকেই বলা হয় বাইয়াত বা “ক্রয়-বিক্রয়” ।
আল্লাহ্‌ রাব্বুল ইজ্জত এরশাদ করেন- آَنَّ اللهَ اَشتَرَى مِنَ المُؤمِنِينَ اَنفُسَهُم وَ اَموَالَهُم بِاَنَّ لَهُمُ الجَنَّةَ يُقَاتِلُونَ فِى سَبِيلِ اللهِ فَيَقتُلُونَ وَ يُقتَلُونَ وَعدَا عَلَيهِ حَقَّا فِى التَّورة وَالاِنجِيلِ وَالقُرأنِ وَ مَن اَوفى بِعَهدِهِ مِنَ اللهِ فَاستَبشِرُوا بِبَيعِكُمُ الَّذِى بَايَعتُمْ بِهِ وَ ذًالِكَ هُوَ الْفًوْزُ الْعَظِيمُ
অর্থাৎ নিশ্চয়ই আল্লাহ খরিদ করে নিয়েছেন মু’মিনদের থেকে তাদের জান ও মাল এর বিনিময়ে যে, অবশ্যই তাদের জন্য রয়েছে জান্নাত। তারা যুদ্ধ করে আল্লাহর পথে, কখনও হত্যা করে এবং কখনও নিহত হয়। তাওরাত ও কুরআনে এ সম্পর্কে সত্য ওয়াদা রয়েছে। আল্লাহর চাইতে নিজের ওয়াদা অধিক পালনকারী আর কে আছে? সুতরাং তোমরা আনন্দ কর তোমাদের সে সওদার জন্য যা তোমরা তাঁর সাথে করেছ। আর তা হল বিরাট সাফল্য। (সূরা তাওবা-১১১)

আল্লাহ তায়ালা বলেন – لَقَد رَضِىَ الله عَنِ المُؤمِنِينَ اِذ يُبَايِعُونَكَ تَحتَ الشَّجَرَةِ অর্থাৎ হে রাসূল! আল্লাহ মু’মিনদের উপর সন্তুষ্ট হয়েছেন যখন তারা গাছের নীচে আপনার নিকট বাইয়া’ত হচ্ছিল। (সূরা ফাতহা : ১৮)

পবিত্র কুরআনের অন্যত্র উল্লেখ আছে– যে ব্যক্তি তার ওয়াদা (প্রতিশ্রুতি) পূর্ণ করবে এবং তাকওয়ার নীতি অবলম্বন করবে, সে আল্লাহ পাকের প্রিয়জন হবে আর নিশ্চিতভাবে আল্লাহ পাক মুত্তাকীদের ভালবাসেন।

আল্লাহ তায়ালা বলেন– ﺇِﻥَّ ﺍﻟَّﺬِﻳﻦَ ﻳُﺒَﺎﻳِﻌُﻮﻧَﻚَ ﺇِﻧَّﻤَﺎ ﻳُﺒَﺎﻳِﻌُﻮﻥَ ﺍﻟﻠَّﻪَ ﻳَﺪُ ﺍﻟﻠَّﻪِ ﻓَﻮْﻕَ ﺃَﻳْﺪِﻳﻬِﻢْ

অর্থাৎ হে রাসূল! যেসব লোক আপনার নিকট বাইয়া’ত হচ্ছিল, তারা আসলে আল্লাহর নিকটই বাইয়া’ত হচ্ছিল। তাদের হাতের উপর আল্লাহর (কুদরতের) হাত ছিল। (সূরা ফাতহা-১০)

আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন– يَاايٌهَا النَّبِىٌّ اِذا جَاءَكَ المُؤمِنتِ ﻳُﺒَﺎﻳِﻌْﻧَﻚَ
অর্থাৎঃ হে রাসূল (দঃ) যে সকল মু’মিন মহিলারা আপনার নিকট বাইয়াত হওয়ার জন্য আসে (মুরিদ হওয়ার জন্য আসে), তাঁদেরকে আপনি বাইয়া’ত দান করুন।(সূরা মুমতাহানা-১২)

হাদিছ শরীফে বর্ণিত আছে যে, হযরত আওফ বিন মালেক আশ’আরী (রাঃ) বলেন, আমরা ৯ জন কিংবা ৮ অথবা ৭ জন নবী করীম (দঃ) এর খেদমতে উপস্থিত ছিলাম। হযরত নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমরা কি আল্লাহর রাসূলের হাতে বাইয়া’ত হবে না? আমরা নিজ নিজ হাত প্রসারিত করে দিলাম এবং বললাম হে আল্লাহ’র রাছুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোন বিষয়ের বাইয়া’ত হব? নবী পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এ বিষয়ের উপর যে তোমরা আল্লাহ পাকের এবাদত করবে, তাঁর সাথে কাউকে শরীক করবে না, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ কায়েম করবে এবং যাবতীয় হুকুম আহকাম শুনবে ও মান্য করবে। (মুসলিম, আবু দাউদ ও নাছাই শরীফ)

অন্য হাদীছ শরীফে এরশাদ হয়েছে- وَ مَن مَاتَ وَ لَيسَ فىِ عُنُقِهِ بَيعَةُ مَاتَ مِيتَةَ جَاهِلِيَّةُ
অর্থাৎ যে ব্যক্তি এমতাবস্থায় মৃত্যু বরণ করলো যে, তার গর্দানে বাইয়া’তের (আনুগত্যের) বেড়ি থাকলো না, সে জাহেলীয়াতের মৃত্যুতে মৃত্যু বরণ করলো।(মুসলীম শরীফ-কিতাবুল ইমারা, হাদীছ নং-৪৮৯৯)।

পীর মাশায়েখগণের মধ্যে বাইয়া’ত করার যে প্রথা প্রচলিত তার সারমর্ম হল জাহেরী ও বাতেনী আমলের উপর দৃঢ়তা অবলম্বন করা এবং গুরুত্ব প্রদান করার অঙ্গীকার করা। তাদের পরিভাষার একে বাইয়া’তে তরীকত অর্থ্যাৎ তরীকতের কাজ বা আমল করার অঙ্গীকার করা। কেহ কেহ এ বাইয়া’তকে অস্বীকার করে থাকেন। কারণ হিসাবে বলেন যে হুজুর পাক (দঃ) হতে তা বর্ণিত নেই। তখন শুধু কাফেরদিগকে ইসলামের বাইয়া’ত করার দরকার ছিল। কিন্তু উল্লেখিত হাদীছ শরীফে এ বিষয়ের স্পষ্ট প্রমাণ বিদ্যমান রয়েছে। তাই অনেক ইমাম মুজতাহিদ আলেমগণ বলেছেন- من ليس له شيخ فشيخه الشيطان
অর্থ্যাৎ যে ব্যক্তি কোন হাক্কানী পীর বা শায়েখ গ্রহণ করেনি তার শায়খ বা ওস্তাদ হয় শয়তান। (জুনায়েদ বাগদাদী রহঃ)
শয়তানই তাকে গোমরাহ বা বিভ্রান্ত করে দেয়। কাজেই গোমরাহী থেকে বাঁচা যেহেতু ফরজ সেহেতু পীর-মুর্শিদের নিকট বাইয়া’ত হওয়া ব্যতীত তা সম্ভব নয়। তাই পীর- মুর্শিদের নিকট বাইয়া’ত হওয়াও ফরজ।

আর ঠিক এ কথাটি বলেছেন আমাদের হানাফী মজহাবের ইমাম, ইমাম আযম আবু হানিফা (রহঃ)। তিনি বলেন, “লাওলা ছানাতানি লাহালাকান নোমান”। অর্থ্যাৎ“আমি নোমান বিন ছাবিত যদি দু’টি বছর না পেতাম তবে হালাক হয়ে যেতাম”। অর্থ্যাৎ যদি আমি আমার পীর সাহেব ইমাম বাকের ও ইমাম জাফর সাদেক (রাঃ) এর নিকট বাইয়া’ত হয়ে দু’টি বছর অতিবাহিত না করতাম তবে আত্মশুদ্ধি লাভ না করার কারণে গোমরাহ ও হালাক (ধ্বংস) হয়ে যেতাম।

আর বিখ্যাত কবি, দার্শনিক ও আলেমকুল শিরোমণি বিশিষ্ট সুফি সাধক হযরত মাওলানা জালালুদ্দীন রুমী (রহঃ) বলেন-
“মাওলানা রুম হারগেজ কামেল নাশুদ; তা গোলামে শামছে তিবরীজ নাশুদ”
অর্থাৎ আমি মাওলানা রুমী ততক্ষন পর্যন্ত আল্লাহ ওয়ালা হতে পারিনি যতক্ষন পর্যন্ত আমার পীর হযরত শামছে তাবরীজ (রহঃ) এর নিকট বাইয়া’ত হয়ে এলমে তাছাউফ আমল করে এখলাছ হাছিল না করেছি অর্থ্যাৎ এলমে তাছাউফ আমলের মাধ্যমে এখলাছ অর্জন করার পরই আমি হাকীকি মু’মিন হতে পেরেছিলাম (মসনবী)।
তাই কাদেরীয়া তরীকার ইমাম হযরত গাউছুল আযম মাহবুবে ছোবহানী কুতুবে রব্বানী গাউছে সামদানী শায়খ মহিউদ্দীন আব্দুল কাদের জীলানী (রহঃ) তাঁর বিখ্যাত কেতাব “সিররুল আসরার” এর ৫ম অধ্যায়ে তওবার বয়ানে লিখেছেন, ক্বলব বা অন্তরকে জীবিত বা যাবতীয় কু-রিপু হতে পবিত্র করার জন্য আহলে তালকীন অর্থ্যাৎ পীরে কামেল গ্রহণ করা প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর জন্য ফরজ।কারণ তাওহীদের রত্ন (বীজ)কোন যোগ্য মুর্শিদের অন্তর থেকে গ্রহণ করতে হবে।
হাদীস শরীফে যে এলেম অর্জন করা ফরজ বলা হয়েছে তদ্বারা এলমে মারেফাত ও কোরবতকেই বুঝানো হয়েছে। এ ছাড়া আরও অন্যান্য সর্বজন মান্য ও সর্বজন স্বীকৃত ইমাম মুজতাহিদ ও আওলিয়া ই-কিরামগণ (রহঃ) পীর-মাশায়েখের নিকট বাইয়া’ত গ্রহণ করা ফরজ বলে ফতওয়া দিয়েছেন।
যেমন হুজ্জাতুল ইসলাম হযরত ইমাম গাজ্জালী (রহঃ) তাঁর “এহইয়াউ উলুমুদ্দীন ও কিমিয়া সায়াদাত” কিতাবে, হযরত খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতি আজমেরী (রহঃ) এর মালফুজাত “আনিসুল আরওয়াহ” কিতাবে, ইমামুশ শরীয়াত ওয়াত তরীকত শায়খ আবুল কাশেম কুশাইরী (রহঃ) “রিছালায়ে কুশাইরিয়া” কিতাবে, হযরত মাওলানা কাজী ছানাউল্লাহ পানিপথি (রহঃ) “মালাবুদ্দা মিনহু ও এরশাদুত্তালেবীন” কিতাবে, শাহ আব্দুল আজিজ মহাদ্দিস দেহলভী (রহঃ) “তাফসীরে আজিজ” নামক কিতাবে, আল্লামা শামী (রহঃ) “রদ্দুল মোখতার” কিতাবে, ইমাম ফখরুদ্দীন রাজী (রহঃ) তার “তাফসীরে কবীর” কিতাবে, কাইয়্যুমে আউয়াল আফজালুল আউলিয়া হযরত ইমাম মোজাদ্দেদে আলফে ছানী (রহঃ) তাঁর বিখ্যাত “মাকতুবাত শরীফে” হযরত ইমাম আহমদ রেফায়ী (রহঃ) তাঁর “বুরহানুল মুআইয়্যাদ” কিতাবে, হযরত ইসমাঈল হাক্কি (রহঃ) “তাফসীরে রুহুল বয়ানে” সরাসরি পীর গ্রহণ করা ফরজ বলে ফতুয়া দিয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে কারামত আলী জৌনপুরীও তাঁর “যাদুত তাকাওয়াতে” লিখেছেন যে এলমে তাছাউফ ব্যতীত ইলমে শরীয়তের উপর যথাযথ আমল করা কিছুতেই সম্ভব নহে। সুতরাং ছাবেত হলো যে এলমে মারেফত চর্চা করা সকলের জন্যই ফরজ বা অবশ্য কর্তব্য। আর এই এলেমে তাছাউফ পারদর্শী মুর্শিদে কামেল এর সোহবত ও তা’লীম ব্যতীত তা অর্জন করা কখনও সম্ভব নয়।
মুফতী শফি সাহেব স্বয়ং নিজেই “মা’আরেফুল কুরআনে” সূরা বাক্বারায় উক্ত আয়াত শরীফের তাফসীরে লেখেন আত্মশুদ্ধি অর্জিত হবে না যতক্ষন পর্যন্ত এছলাহ প্রাপ্ত কোন বুর্যুর্গ বা পীরে কামেলের অধীনে থেকে তালীম ও তরবিয়াত হাসিল না করবে। আমল করার হিম্মত তাওফিক কোন কিতাব পড়া ও বুঝার দ্বারা অর্জিত হয় না, তা অর্জন করার একটি পথ তা হলো অলীগণের সোহবত।
পীর-মুর্শিদগণই হচ্ছেন হাকীকি আলেম। কেননা পীর-মুর্শিদগণই এলমে শরীয়ত ও মারেফত এই উভয় প্রকার এলমের অধিকারী। আর উক্ত উভয় প্রকারের এলমের অধিকারীগণই হচ্ছেন হাদীছ শরীফের ঘোষণা অনুযায়ী- العلماء ورثة الانبياء প্রকৃত আলেম বা ওয়ারাসাতুল আম্বিয়া। যেমন এ প্রসঙ্গে ইমামে রব্বানী মাহবুবে সুবহানী কাইয়ূমে আওয়াল সুলতানুল মাশায়েখ হযরত মোজাদ্দেদ আলফে ছানি (রহঃ) তাঁর বিখ্যাত কিতাব মকতুবাত শরীফে উল্লেখ করেন আলিমগণ নবীগণের ওয়ারিছ। এ হাদীস শরীফে বর্ণিত আলেম তারাই যাঁরা নবীগণের রেখে যাওয়া এলমে শরীয়ত ও এলমে মারিফত এই উভয় প্রকার এলমের অধিকারী। অর্থ্যাৎ তিনিই প্রকৃত ওয়ারিছ বা স্বত্বাধিকারী। আর যে ব্যক্তি শুধুমাত্র এক প্রকারের এলমের অধিকারী সে ব্যক্তি নবীগণের প্রকৃত ওয়ারিশ নয়। কেননা পরিত্যক্ত সম্পত্তির সকল ক্ষেত্রে অংশিদারী হওয়াকেই ওয়ারিছ বলে। আর যে ব্যক্তি পরিত্যক্ত সম্পত্তির কোন নির্দিষ্ট অংশের অধিকারী হয় তাকে গরীম বলে। অর্থ্যাৎ সে ওয়ারিছ নয় গরীমের অন্তর্ভূক্ত। পক্ষান্তরে যারা পীর-মাশায়েখ নয় অর্থ্যাৎ শুধু এলমে শরীয়তের অধিকারী এলমে তাছাউফ শুন্য তারা প্রকৃত আলেম নয়।
এতএব, প্রমাণিত হলো হক্কানী পীর-মাশায়েখগণই হচ্ছেন প্রকৃত বা খাঁটি আলেমে দ্বীন। ক্বলব জারী করতে হলে তাঁদের কাছে যেতে হবে। যে ব্যক্তি কোন পীর-মাশায়েখের নিকট বাইয়া’ত হয়ে আত্মশুদ্ধি লাভ করতঃ খিলাফত প্রাপ্ত হয়নি তার নিকট বাইয়া’ত হওয়া অনুচিত।
এতএব, আত্মশুদ্ধি ও এলমে তাছাউফ অর্জন করা যেহেতু ফরজে আইন। আর কামেল পীর-মাশায়েখ ব্যতীত এলমে তাছাউফ বা আত্মশুদ্ধি অর্জন করা সম্ভব নয় সেহেতু একজন কামেল পীর-মুর্শিদ অন্বেষণ করে বাইয়া’ত গ্রহণ করা ফরজ। এটাই গ্রহণ যোগ্য বিশুদ্ধ ও দলীল ভিত্তিক ফতওয়া। এর বিপরীত মত পোষণ কারীরা বাতিল ও গোমরাহ।