সাদাকাতুল ফিতর কি টাকা দিয়ে আদায় হয় না?

আমাদের দেশে প্রায় সবাই টাকা দিয়ে সাদাকাতুল ফিতর আদায় করে থাকেন। যুগ যুগ ধরে প্রজন্মের পর প্রজন্ম সবাই এভাবেই সাদাকাতুল ফিতর আদায় করে আসছেন। কিন্তু ইদানিং আমাদের কিছু কিছু ভাই একটি কথা বেশ জোরে প্রচার করছেন যে, টাকা দিয়ে সাদাকাতুল ফিতর আদায় করলে নকি আদায় হবে না; বরং খেজুর, যব, আটা ইত্যাদি খাবার দিতে হবে। বিষয়টি নিয়ে একটু ধুম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে। এসংক্রান্ত সংশয় নিরসনের জন্যেই আজকের এই লেখার আয়োজন।

আমাদের ঐ সকল ভাইদের বক্তব্য হচ্ছে, হাদিস শরিফে পাঁচটি জিনিস দিয়ে সাদাকাতুল ফিতর আদায়ের কথা বলা হয়েছে: খেজুর, যব, কিসমিস, পনির, আটা। এসম্পর্কে হাদিস এসেছে এরকম :

ক. হযরত ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাদকাতুল ফিতর হিসাবে খেজুর হোক অথবা যব হোক এক সা’ পরিমাণ আদায় করা আবশ্যক করেছেন এবং লোকজনের ঈদের সালাতে বের হওয়ার পূর্বেই তা আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন। সহিহ বুখারি, হাদিস 1506

খ. হযরত ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাদকাতুল ফিতর হিসাবে খেজুর হোক অথবা যব হোক এক সা’ পরিমাণ আর গম আধা সা পরিমাণ আদায় করা আবশ্যক করেছেন।-আবু দাউদ, হাদিস 1622; নাসায়ি, 580; ইবনে খুযাইমা, 2260; মুসতাদরাকে হাকিম: 1/410

তাহলে দেখা গেল হাদিস শরিফে খেজুর, যব ইত্যাদির দ্বারা সাদাকাতুল ফিতর আদায় করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু টাকা কিংবা মূল্য দিয়ে তো সাদাকাতুল ফিতর আদায় করার কথা কোথাও বলা হয় নি; অথচ নবীজীর সময়ে দিরহাম দিনার ছিল।

যদি মূল্য দিয়ে সাদাকাতুল ফিতর আদায় করা বৈধ হতো, তাহলে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খেজুর, যব ইত্যাদির সাথে এতো দিরহাম কিংবা এতো দিনার হবে, এটাও বলে দিতেন।

এই হচ্ছে আমাদের ঐসকল ভাইদের বক্তব্য। কিন্তু বাস্তবতা কি তাই? বাস্তবেই কি টাকা দিয়ে সাদাকাতুল ফিতর আদায় হবে না?

না, বাস্তবতা এমন নয়। দেখুন, হাদিস শরিফে পাঁচটি বস্তুর দ্বারা সাদাকাতুল ফিতর আদায়ের কথা বলা হয়েছে এটা ঠিক; কিন্তু হাদিসের উদ্দেশ্য কি শুধু এই পাঁচটি বস্তুই? নাকি ঐ পাঁচটি বস্তু কিংবা এর সমমূল্য উদ্দেশ্য?

বিষয়টি পরিষ্কার হওয়ার জন্য একটি উদাহরণ দেখুন। হাদিস শরিফে উষ্ট্রের যাকাত উষ্ট্র দিয়ে, বকরীর যাকাত বকরী দিয়ে, শস্যের যাকাত শস্য দিয়ে, পণ্যের যাকাত পণ্য দিয়ে দেওয়ার কথা এসেছে।

হযরত মুআয ইবনে জাবাল রা. এর হাদিসে বিষয়টি খুবই সুস্পষ্টভাবে ফুটে ‍উঠেছে। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে ইয়ামানে প্রেরণ করার সময় বলেছিলেন-
خُذِ الْحَبَّ مِنَ الْحَبِّ، وَالشَّاةَ مِنَ الْغَنَمِ، وَالْبَعِيرَ مِنَ الإِبِلِ، وَالْبَقَرَةَ مِنَ الْبَقَرِ
‘ফসল থেকে ফসল, বকরীপাল থেকে ছাগল, উটপাল থেকে উষ্ট্রী, গরুর পাল থেকে গাভী যাকাত হিসেবে গ্রহণ করবে।’-আবু দাউদ, হাদিস 1599; ইবনে মাজা, হাদিস 1814; মুসতাদরাকে হাকিম: 1/388

হযরত মুআয রা. কি করলেন? তিনি সেখানে গিয়ে ইয়ামানবাসীদেরকে বললেন, তোমরা যব ও ভুট্টার পরিবর্তে চাদর বা পরিধেয় বস্ত্র আমার কাছে যাকারস্বরূপ নিয়ে আস। ওটা তোমাদের পক্ষেও সহজ এবং মদীনায় নবীজীর সাহাবীদের জন্যেও উত্তম। দেখুন সহিহ বুখারিতে (4/280) হযরত মুআয রা. এর বক্তব্য।

লক্ষ করুন, নবীজীর এতো সুস্পষ্ট নির্দেশনা সত্ত্বেও হযরত মুআয রা. যব এবং ভুট্টার পরিবর্তে চাদর এবং পরিধেয় বস্ত্র গ্রহণ করলেন। তাহলে কি হযরত মুআয রা. নবীজীর নির্দেশ অমান্য করলেন? না, তিনি নবীজীর নির্দেশ অমান্য করেন নি। তাহলে?

যেকোনো বিবেকবান মানুষ এটাই বলবে যে তিনি নবীজীর নির্দেশ অমান্য করেন নি। বরং তিনি ভাল করেই বুঝেছেন নবীজীর নির্দেশের বাহ্যিক অর্থ অর্থাৎ হুবহু উষ্ট্র, বকরী, শস্যই গ্রহণ করা এখানে তাঁর উদ্দেশ্য নয়। বরং নবীজীর উদ্দেশ্য হচ্ছে ঐসকল বস্তু কিংবা এর সমমূল্য।

সাদাকাতুল ফিতরের ক্ষেত্রে একই রকম ঘটেছে। অর্থাৎ নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাদাকাতুল ফিতর আদায়ের জন্য নির্ধারিত কয়েকটি বস্তুর নাম বলেছেন। কিন্তু এর উদ্দেশ্য কখনোই এই নয় যে হুবহু এই বস্তুগুলোই দিতে হবে; এগুলোর মূল্য কিংবা সমমূল্যের বস্তু দিলে আদায় হবে না। বিষয়টি এমন নয়। বরং নবীজীর উদ্দেশ্য হচ্ছে, হুবহু ঐবস্তুগুলো দিলে যেমন সাদাকাতুল ফিতর আদায় হবে ঐগুলোর মূল্য হিসেব করে আদায় করলেও আদায় হয়ে হবে।

সাহাবায়ে কেরাম রা. সাদাকাতুল ফিতর সংক্রান্ত নির্দেশনাটি এভাবেই বুঝেছেন। একারণেই সাহাবায়ে কেরাম রা. থেকে হাদিসে বর্ণিত খাদ্য-শস্য দিয়ে সাদাকাতুল ফিতর আদায়ের কথা যেমন পাওয়া যায় তেমনিভাবে মূল্য দিয়ে সাদাকাতুল ফিতর আদায়ের প্রমাণও তাদের কাছ থেকেই পাওয়া যায়।

দেখুন, হযরত আবু সাঈদ খুদরি রা. বলেন-‘আমরা সদকাতুল ফিতর আদায় করতাম এক ‘সা’ খাদ্য (গম) দ্বারা অথবা এক ‘সা’ যব অথবা এক ‘সা’ খেজুর, কিংবা এক ‘সা’ পনির বা এক ‘সা’ কিসমিস দ্বারা। -মুয়াত্তা মালেক পৃ. ১২৪; -সহিহ বুখারি, হাদিস 1472; সহিহ মুসলিম, হাদিস 986

এই বর্ণনায় হাদিসে বর্ণিত বস্তুগুলো দিয়ে সাদাকাতুল ফিতর আদায়ের বিষয়টি ফুটে উঠেছে।

অপরদিকে আবু ইসহাক আস সাবিয়ির রহ. এর বর্ণনায় সাহাবায়ে কেরামের মূল্য দিয়ে সাদাকাতুল ফিতর আদায়ের বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে।

مصنف ابن أبي شيبة (2/ 398)
فِي إِعْطَاءِ الدَّرَاهِمِ فِي زَكَاةِ الْفِطْرِ
10371 – حَدَّثَنَا أَبُو أُسَامَةَ، عَنْ زُهَيْرٍ، قَالَ: سَمِعْتُ أَبَا إِسْحَاقَ، يَقُولُ: «أَدْرَكْتُهُمْ وَهُمْ يُعْطُونَ فِي صَدَقَةِ رَمَضَانَ الدَّرَاهِمَ بِقِيمَةِ الطَّعَامِ»

অর্থ : হযরত যুহাইর (রহ.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি আবূ ইসহাক (রহ.) থেকে শুনেছি যে, তিনি বলেছেন, আমি সাহাবায়ে কেরাম (রা.) কে এই অবস্থায় পেয়েছি যে, তারা রমজানে সাদাকায়ে ফিতর খাবারের বিনিময়ে টাকা দ্বারা আদায় করতেন। -ইবনে আবি শায়বা-২/৩৯৮, হাদীস-১০৩৭১। এটির সনদ সম্পূর্ণ সহীহ তথা প্রমাণিত।

তিনি বলেন, আমি সাহাবায়ে কেরাম রা. কে এই অবস্থায় পেয়েছি যে, তারা রমযানে সাদাকাতুল ফিতর আদায় করতেন খাবার সমমূল্যের দিরহাম দিয়ে। -মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা-10472; আল আমওয়াল, ইবনে যানজুইয়া, হাদিস 3454 [হাদিসের সনদ সহিহ]

যাইহোক, এই রেওয়ায়েত থেকে এবিষয়টি পরিস্কার যে সাহাবায়ে কেরাম রা. দিরহাম (টাকা) দ্বারা সাদাকাতুল ফিতর আদায় করতেন।

রেওয়াতেটির বর্ণনাকারী আবু ইসহাক আস-সাবিয়ি হচ্ছেন, একজন জলিলুল কদর তাবিয়ি। তিনি 33 হিজরিতে হযরত উসমান রা. এর খেলাফতকালে জন্ম গ্রহণ করে 127 হিজরিতে মৃত্যু বরণ করেন। হযরত আলী রা. সহ ৩৮ জন মতান্তরে 27 জন্য সাহাবিকে পেয়েছেনে। আর বড় বড় কত তাবিয়িকে পেয়েছেন, এর কোনো হিসাবই নেই। বিস্তারিত দেখুন, সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা 5/392; তাহযিবুল কামাল: 22/102

তাঁর রেওয়ায়েতের আরবি নস এরকম-
أَدْرَكْتُهُمْ وَهُمْ يُعْطُونَ فِي صَدَقَةِ رَمَضَانَ الدَّرَاهِمَ بِقِيمَةِ الطَّعَامِ
এই রেওয়ায়েতের একটি শব্দ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আবু ইসহাক বলেছেন, أَدْرَكْتُهُمْ যার অর্থ আমি তাদেরকে পেয়েছি। এই তাদেরকে মানে কাদেরকে?

এমন একজন তাবিয়ি যিনি ত্রিশের উর্ধ্বে সাহাবিকে পেয়েছেন তিনি যখন বলেন, তাদেরকে পেয়েছি, এর দ্বারা যেকোনো বিবেকবান মানুষেরই বুঝতে অসুবিধা হয় না যে এর দ্বারা উদ্দ্যেশ্য হচ্ছে সাহাবায়ে কেরাম।

একথাটিই বলেছেন, প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস, মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবার মুহাক্কিক শায়খ মুহাম্মদ আওয়ামাহ দা. বা.। তিনি বলেন-
وأبو اسحاق أدرك كثيرا من الصحابة فقوله أدركتهم يريد به الصحابة
‘আবু ইসহাক অনেক সাহাবিকে পেয়েছেন। সুতরাং তার أَدْرَكْتُهُمْ কথাটির দ্বারা সাহাবায়ে কেরামই উদ্দেশ্য। মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা-10472

ঠিক একথাটিই বলেছেন সালাফি শাইখ আরব বিশ্বের নামকরা আলেম ড. সালিহ আল উযাইব হাফি.। তিনি বলেন-
وهذا أبو أسحاق السبيعي أدرك عليا وبعض الصحابة رضي الله عنهم – يثبت أن ذلك كان معمولا به في عصرهم فقوله أدركتهم يعني به الصحابة.
এই আবু ইসহাক আস সাবিয়ি হযরত আলি রা. সহ কিছু সাহাবীদের কে পেয়েছেন। সুতরাং তার أَدْرَكْتُهُمْ কথাটির দ্বারা সাহাবায়ে কেরামই উদ্দেশ্য। তিনি আরো বলেন, এর দ্বারা একথা প্রমাণিত হয় যে টাকা দিয়ে সদকাতুল ফিতর আদায়ের বিষয়টি সাহাবিদের যুগে প্রচলিত ছিল।

যাইহোক, একথা সুস্পষ্ট যে সাহাবায়ে কেরাম যাকাতের হাদিসকে যেমন বাহ্যিক অর্থে প্রয়োগ না করে নবীজীর মূল উদ্দেশ্য বুঝে নির্ধারিত বস্তুর পাশাপাশি মূল্য ধরে যাকাত দিতেন, তেমনিভাবে সাদাকাতুল ফিতরের ক্ষেত্রেও নবীজীর মূল উদ্দেশ্য বুঝে হাদিসে বর্ণিত বস্তু দিয়ে যেমন সাদাকাতুল ফিতর আদায় করতেন, এগুলোর মূল্য ‍দিয়েও সাদাকাতুল ফিতর আদায় করতেন।

এতক্ষণ আমরা সাহাবিদের কথা আলোচনা করলাম। তাবেয়িনদের সময়ে তো টাকা দিয়ে আদায় করার বিষয়টি এক পর্যায়ে ব্যক্তি বিশেষে সীমাবদ্ধ থাকে নি; বরং রাষ্ট্রীয়ভাবেই সাদাকাতুল ফিতর মূল্য দিয়ে আদায় করার নিয়ম চালু হয়।

এসম্পর্কে কুররা ইবনে খালিদ বলেন, এ বিষয়ে হযরত ওমর বিন আব্দুল আযীয (রহ.) এর চিঠি-

مصنف ابن أبي شيبة (2/ 398)
10369 – حَدَّثَنَا وَكِيعٌ، عَنْ قُرَّةَ، قَالَ: جَاءَنَا كِتَابُ عُمَرَ بْنِ عَبْدِ الْعَزِيزِ فِي صَدَقَةِ الْفِطْرِ «نِصْفُ صَاعٍ عَنْ كُلِّ إِنْسَانٍ أَوْ قِيمَتُهُ نِصْفُ دِرْهَمٍ»

(ইবনে আবি শায়বা-২/৩৯৮, হাদীস-১০৩৬৯) আমাদের নিকট খলিফাতুল মুসলিমিন হযরত উমর বিন আব্দুল আযিযের পক্ষ থেকে পত্র আসল যে প্রত্যেক ব্যক্তি যেন আধা ‘সা’ (গম) অথবা তার মূল্য আধা দিরহাম সাদাকাতুল ফিতর হিসেবে প্রদান করে। [মুছান্নাফে ইবনে আবি শায়বা: 6/508] রেওয়ায়েতটি সহিহ, কুররা ইবনে খালিদ একজন নির্ভরযোগ্য রাবি। তাঁর থেকে রেওয়ায়েতটি বর্ণনা করেছেন ওয়াকি ইবনুল জাররাহ]

উমর ইবনে আব্দুল আযিযের চিঠির বিষয়টি সহিহ সনদে হযরত আওফ রা. থেকেও বর্ণিত হয়েছে। হযরত আওফ বলেন আমি উমর ইবনে আব্দুল আযিযের চিঠি শুনেছি। ভাতা প্রাপ্তদের প্রত্যেকের কাছ থেকে যেন আধা দিরহাম সাদাকাতুল ফিতর গ্রহণ করা হয়। [মুছান্নাফে ইবনে আবি শাইবাহ: 6/508; আল আমওয়াল, ইবনে যানজুইয়া, হাদিস 2453]

আরো দেখুন, প্রসিদ্ধ তাবেয়ি হযরত হাসান বসরী রহ. কি বলেন। তিনি বলেন,

مصنف ابن أبي شيبة (2/ 398)
10370 – حَدَّثَنَا وَكِيعٌ، عَنْ سُفْيَانَ، عَنْ هِشَامٍ، عَنِ الْحَسَنِ، قَالَ: «لَا بَأْسَ أَنْ تُعْطِيَ الدَّرَاهِمَ فِي صَدَقَةِ الْفِطْرِ»

অর্থ : হযরত হাসান বসরী (রহ.) বলেন, টাকা দ্বারা সাদাকায়ে ফিতর আদায় করার দ্বারা কোন সমস্যা নেই। ইবনে আবি শায়বা-২/৩৯৮, হাদীস-১০৩৭০। আল আমওয়াল, ইবনে যানজুইয়া, হাদিস 2454]

লক্ষ করুন, উমর ইবনে আব্দিল আযিয রহ. রাষ্ট্রীয় নির্দেশ জারি করলেন, এমন এক সময় যখন অসংখ্য তাবিয়ি জীবিত; কিন্তু একজনও একটু প্রতিবাদ করলেন না যে না, মূল্য দিয়ে তো সাদাকাতুল ফিতর আদায় হয় না সুতরাং এটা শরিয়ত-বিরোধী। কেউ কিন্তু এমন কথা বলেন নি।

এর মানে কি এই নয় যে বিষয়টি ঐ সময় সবার জানা ছিল এবং সবার কাছেই বিষয়টি স্বীকৃত ছিল যে, হাদিসে বর্ণিত খাদ্য দিয়ে যেমন সাদাকাতুল ফিতর আদায় করা যায়, তেমনিভাবে টাকা দিয়েও আাদায় করা যায়?

বুঝা গেল, টাকা দ্বারা সাদাকাতুল ফিতর আদায় করা এটি আমলে মুতাওয়ারিছ তথা সাহাবায়ে কেরাম এবং তাবেয়িনদের কর্মপরম্পরা দ্বারা প্রমাণিত। অর্থাৎ সাহাবা এবং তাবেয়িগণ হাদিসে বর্ণিত খাদ্য-শস্যের দ্বারা যেমন সাদাকাতুল ফিতর আদায় করেছেন তেমনিভাবে এগুলোর মূল্য দিয়েও আদায় করেছেন।

অথচ নবীজীর হাদিস তাদের সামনেই ছিল। এর মানে তো এটাই যে তারা নবীজীর কথার অর্থ এটাই বুঝেছেন যে শুধু এই খাদ্য-শস্য গুলোই উদ্দেশ্য নয়; বরং এগুলো দিলে যেমন সাদাকাতুল ফিতর আদায় হবে তেমনিভাবে এগুলোর মূল্য দিলেও সাদাকাতুল ফিতর আদায় হয়ে যাবে। এটাই নবীজীর উদ্দেশ্য।

আরেকটি বিষয় লক্ষ করুন। ইতোপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে, যাকাতের ক্ষেত্রে নবীজীর সুস্পষ্ট নির্দেশ সত্ত্বেও হযরত মুআয রা. মূল্যের প্রতি লক্ষ করে যব এবং ভুট্টার পরিবর্তে চাদর এবং পরিধেয় বস্ত্র গ্রহণ করে বলেছিলেন, ‘ওটা তোমাদের পক্ষেও সহজ এবং মদীনায় নবীজীর সাহাবীদের জন্যেও উত্তম।’ অর্থাৎ আদায়কারী এবং গ্রহণকারী উভয়ের জন্য যেটি বেশি উপযোগী, যাকাতের ক্ষেত্রে এটির প্রতি বিশেষভাবে লক্ষ রাখা হয়েছে। ইয়ামানবাসীর জন্য যব, ভুট্টার পরিবর্তে বস্ত্র দেওয়া সহজ ছিল আবার মদীনাবাসীরও ঐ সময় যব, ভুট্টার পরিবর্তে বস্ত্রের প্রয়োজন ছিল তাই যাকাত প্রদানকারী এবং গ্রহণকারী উভয়ের জন্য যেটা বেশি উপযোগী সেটির প্রতি বিশেষভাবে লক্ষ রেখে হযরত মুআয রা. এই আদেশ জারি করেছিলেন।

একই কথা সাদাকাতুল ফিতরের ক্ষেত্রেও। অর্থাৎ নবীজীর সময়ে খাদ্য-শস্য মদীনাবাসীর জন্য উপযোগী ছিল এবং এগুলো তাদের খুব প্রয়োজন ছিল তাই তখন খাদ্য-শস্য দেওয়ার কথা বলেছিলেন; কিন্তু এখন মানুষের জন্য টাকাই বেশি উপযোগী, বেশি প্রয়োজনীয়। সুতরাং এখন সাদাকাতুল ফিতর হিসেবে টাকা দেওয়াই বেশি উত্তম হবে। এটি দরিদ্রদের জন্যও বেশি উপকারী হবে।

আরো দেখুন, ইমাম সুফিয়ান সাওরী (রহঃ) বলেন,

لا يشترط إخراج التمر أو الشعير أو البر في زكاة الفطر بل لو أخرج قيمتها مما هو أنفع للفقير جاز لأن المقصد منها إغناء الفقراء عن المسألة وسد حاجتهم في هذا اليوم

খেজুর, গম বা যব দিয়ে সদকায়ে ফিতর আদায় করা আবশ্যক নয়। বরং যদি এর মূল্য দ্বারা আদায় করা হয়, যা গরীবদের জন্য অধিক উপকারী, তবে তা জায়েজ আছে। কেননা, সদকার দ্বারা মূল মাকসাদ হল, গরীবদের দারিদ্রতা দূর করা এবং তার সেদিনের প্রয়োজন পূর্ণ করা। [মাউসূআতু ফিক্বহি সুফিয়ান সাওরী-৪৭৩]

টাকা দ্বারা সদকায়ে ফিতর আদায়ের মত ব্যক্ত করেছেন, ইমাম আবূ হানীফা (রহঃ), ইমাম সুফিয়ান সাওরী (রহঃ), উমর বিন আব্দুল আজীজ (রহঃ), হযরত হাসান বসরী (রহঃ), ইমাম আবু ইউসুফ (রহঃ), ইমাম তাহাবী (রহঃ), ইমাম ইসহাক বিন রাহুয়াই (রহঃ), ইমাম আবু সাউর (রহঃ)। [যাকাতুল ফিতরি আহকামূহা ওয়া নাওয়াজিলুহা, মুহাম্মদ বিন আব্দুল গাফফার শরীফ কৃত-১২৫]

قَالَ بن رَشِيدٍ وَافَقَ الْبُخَارِيُّ فِي هَذِهِ الْمَسْأَلَةِ الْحَنَفِيَّةَ

ইবনে রশীদ বলেন, ইমাম বুখারী (রহঃ) এ মাসআলায় [টাকা দিয়ে সদকায়ে ফিতর আদায় করা] হানাফীদের সাথে সহমত পোষণ করেছেন। [ফাতহুল বারী-৩/৪৯৭

সুতরাং এই প্রশ্নের কোন অবকাশ নেই যে খাদ্য-শস্যের মত টাকা দিয়েও যদি সাদাকাতুল ফিতর আদায় করা বৈধ হয় তাহলে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কেন দিরহাম দীনারের কথা বললেন না? তখন তো দিরহাম দিনার ছিল।

আল্লাহ তাআলা সবাইকে বুঝার তওফিক দান করুন। আমিন।