সাওম/রোজার পরিচয়ঃ শরিয়ত মতে যাদের মধ্যে সাওম/রোজা রাখার উপযুক্ততা বিদ্যমান আছে, তারা ছোবহে সাদিকের পূর্বক্ষণ হতে সূর্যাস্ত যাওয়া পর্যন্ত আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য লাভের নিয়তে পানাহার ও সহবাস হতে বিরত থাকার নাম সাওম/রোজা।

যে ব্যক্তির মধ্যে ৫টি শর্ত বা উপযুক্ততা পাওয়া যায় তার উপর রোজা পালন করা ওয়াজিব –

এক: মুসলিম হওয়া

দুই: মুকাল্লাফ হওয়া অর্থাৎ শরয়ি বিধি-বিধানের ভারপ্রাপ্ত হওয়া

তিন: রোজা পালনে সক্ষম হওয়া

চার: নিজগৃহে অবস্থানকারী বা মুকীম হওয়া

পাঁচ: রোজা পালনের প্রতিবন্ধকতাসমূহ হতে মুক্ত হওয়া

এই পাঁচটি শর্ত যে ব্যক্তির মধ্যে পাওয়া যায় তার উপর সিয়াম পালন করা ওয়াজিব।

প্রথম শর্তঃ

প্রথম শর্তের মাধ্যমে কাফের ব্যক্তি রোজা পালনের দায়িত্ব থেকে বেরিয়ে গেল। কাফেরের উপর রোজা পালন অনিবার্য নয়। আর কাফের তা পালন করলেও শুদ্ধ হবে না। কারণ তারা যতক্ষণ ঈমান গ্রহণ করবে না ততক্ষ্ণ মুমিনদের কোনো কাজের প্রতি আদিষ্ট নয়।

আল্লাহ তাআলার বাণী:

وَمَن يَبْتَغِ غَيْرَ الْإِسْلَامِ دِينًا فَلَن يُقْبَلَ مِنْهُ وَهُوَ فِي الْآخِرَةِ مِنَ الْخَاسِرِينَ ( 3 سورة ال عمران – 85)

– যে ব্যক্তি ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো দ্বীন বা জীবন বিধান অন্বষণ করবে, তা কখনো গ্রহণ করা হবে না। সে পরকালে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভূক্ত হবে। ( ৩ আলে ইমরান – ৮৫)

وَمَا مَنَعَهُمْ أَن تُقْبَلَ مِنْهُمْ نَفَقَاتُهُمْ إِلَّا أَنَّهُمْ كَفَرُوا بِاللَّهِ وَبِرَسُولِهِ وَلَا يَأْتُونَ الصَّلَاةَ إِلَّا وَهُمْ كُسَالَىٰ وَلَا يُنفِقُونَ إِلَّا وَهُمْ كَارِهُونَ( 9 سورة التوبة – 54)

“তাদের অর্থ ব্যয় কবুল না হওয়ার এছাড়া আর কোন কারণ নেই যে, তারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের প্রতি অবিশ্বাসী, তারা নামাযে আসে অলসতার সাথে, ব্যয় করে সঙ্কুচিত মনে।” [৯ সুরা তাওবা : ৫৪]

দ্বিতীয় শর্ত:

মুকাল্লাফ বা শরয়ি ভারপ্রাপ্ত হওয়া। মুকাল্লাফ হচ্ছেন- বিবেক-বুদ্ধি সম্পন্ন সাবালক ব্যক্তি। কারণ নাবালক কিংবা পাগলের উপর কোন শরয়ি ভার নেই। কোন নাবালকের বালেগ হওয়া তিনটি বিষয়ের যে কোন একটির মাধ্যমে সাব্যস্ত হয়। বুদ্ধিসম্পন্ন এর বিপরীত হল পাগল তথা বিবেক-বুদ্ধিহীন। সে পাগল উচ্ছৃঙ্খল হোক অথবা শান্ত হোক এবং তার পাগলামি যে ধরনের হোক না কেন সে শরয়ি ভারপ্রাপ্ত বা মুকাল্লাফ নয়। তার উপর দ্বীনের কোন আবশ্যকীয় (ওয়াজিব) দায়িত্ব নেই। যেমন- নামায, রোজা, মিসকীনকে খাওয়ানো ইত্যাদি। অর্থাৎ তার উপর কোন কিছু ওয়াজিব নয়।

তৃতীয় শর্ত: সক্ষম হওয়া। অর্থাৎ সিয়াম পালনে সক্ষম হওয়া। অতএব, যে ব্যক্তি অক্ষম তার উপর সিয়াম পালন করা ওয়াজিব নয়। এর দলিল আল্লাহ তাআলার বাণী:

( ومن كان مريضا أو على سفر فعدةٌ من أيام أُخر ) [ 2 البقرة: 185]

“আর যে ব্যক্তি অসুস্থ অথবা যে ব্যক্তি সফরে আছে তারা সেই সংখ্যা অন্য দিনগুলোতে পূরণ করবে।”[২ আল-বাক্বারাহ : ১৮৫]

অক্ষমতা দুই প্রকার: সাময়িক অক্ষমতা ও স্থায়ী অক্ষমতা।

(১.) সাময়িক অক্ষমতার কথা ইতিপূর্বে উল্লেখিত আয়াতে এসেছে। যেমন- এমন রোগী যার সুস্থতা আশা করা যায় এবং মুসাফির। এ ব্যক্তিদের জন্য রোজা না-রাখা জায়েয আছে। তারা ছুটে যাওয়া দিনগুলোর রোজা পরে কাযা করবেন।

(২.) স্থায়ী অক্ষমতা। যেমন- এমন রোগী যার সুস্থতা আশা করা যায় না এবং এমন বৃদ্ধ লোক যিনি সিয়াম পালনে অক্ষম। এ অক্ষমতার বিষয় নিম্নোক্ত আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে।

وَعَلَى الَّذِينَ يُطِيقُونَهُ فِدْيَةٌ طَعَامُ مِسْكِينٍ  [البقرة: 184]

“আর যারা রোজা পালনে অক্ষম তারা ফিদিয়া দিবে (অর্থাৎ মিসকীন খাওয়াবে)।” [২ সূরা বাক্বারা: ১৮৪]

এই আয়াতের তাফসীরে ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন- “বৃদ্ধ ও বৃদ্ধা যারা রোজা পালনে সক্ষম নয় তারা প্রতিদিনের বদলে একজন মিসকীনকে খাওয়াবে।”

চতুর্থ শর্ত: নিজ গৃহে অবস্থানকারী বা মুকীম হওয়া। সুতরাং মুসাফিরের উপর রোজা পালন করা ওয়াজিব নয়। এর দলিল আল্লাহ তাআলা বাণী:

( ومن كان مريضاً أو على سفر فعدةٌ من أيامٍ أُخر ) [ 2 البقرة: 185]

“আর যে ব্যক্তি অসুস্থ অথবা যে ব্যক্তি সফরে আছে তারা সেই সংখ্যা অন্য দিনগুলোতে পূরণ করবে।”[২ আল-বাক্বারাহ : ১৮৫]

আলেমগণ ইজমা (ঐকমত্য) করেছেন যে, মুসাফিরের জন্য রোজা না-রাখা জায়েয। তবে উত্তম হলো- তার জন্য যেটা বেশি সহজ সেটা করা। পক্ষান্তরে যদি রোজা পালন করায় তার স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয় তবে তার জন্য রোজা পালন করা হারাম। এর দলিল হচ্ছে- ‌আল্লাহ তাআলার বাণী:

( ولا تقتلوا أنفسكم إن الله كان بكم رحيما ) [ 4 النساء: 29]

“তোমরা আত্মহত্যা করো না। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের প্রতি অতি দয়াময়।”[৪ আন-নিসা :২৯]

এই আয়াত থেকে এই নির্দেশনা পাওয়া যায় যে, যা মানুষের জন্য ক্ষতিকর তা তার জন্য নিষিদ্ধ।

আপনি যদি বলেন সেই ক্ষতি কিভাবে পরিমাপ করা হবে, যা রোজা রাখা হারাম করে দেয়? জবাব হল: সে ক্ষতিটা ইন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করা সম্ভব অথবা তথ্যের ভিত্তিতে জানা সম্ভব।

(১.) ইন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করা অর্থাৎ রোগী নিজেই অনুভব করা যে রোজা পালন করার কারণে তার স্বাস্থ্যের ক্ষতি হচ্ছে, রোগ বেড়ে যাচ্ছে এবং সুস্থতা বিলম্বিত হচ্ছে ইত্যাদি।

(২.) আর তথ্যের মাধ্যমে ক্ষতি সম্পর্কে জানার অর্থ হল- একজন বিজ্ঞ ও বিশ্বস্ত ডাক্তার রোগীকে এ তথ্য দিবে যে রোজা পালন করা তার স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।

পঞ্চম শর্ত: রোজা পালনে কোন প্রতিবন্ধকতা না থাকা। এ শর্তটি নারীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। হায়েয ও নিফাস অবস্থায় নারীর জন্য সিয়াম পালন অনিবার্য নয় এবং এর দলীল হল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী:

” أليس إذا حاضت لم تصل و لم تصم “

“একজন নারীর হায়েয (মাসিক) হলে সে কি নামায ও রোজা ত্যাগ করে না?”[আল- বুখারী: ২৯৮]

আলেমগণের ইজমা (সর্বসম্মতি) এর ভিত্তিতে হায়েয ও নিফাস অবস্থায় নারীর উপর রোজা পালন করা ওয়াজিব নয়। এমতাবস্থায় রোজা পালন করলে শুদ্ধ হবে না। বরং পরবর্তীতে এই দিনগুলোর রোজা কাযা আদায় করা বাধ্যতামূলক।[আশ-শারহুল-মুমতি (৬/৩৩০)]