হযরত মিসওয়ার ইবনে মাখরামাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু ও মারওয়ান রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তাদের উভয়ের একজনের বর্ণনা অপরজনের বর্ণনার সমর্থন করে তারা বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হুদায়বিয়ার সময় বের হলেন। যখন সাহাবীগন রাস্তার এক জায়গায় এসে পৌঁছলেন, তখন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘খালিদ ইবনে ওয়ালিদ কুরাইশদের অশ্বারোহী অগ্রগামী বাহিনী নিয়ে গোমায়ম নামক স্থানে অবস্থান করছে। তোমরা ডান দিকে চল’ আল্লাহর কসম! খালিদ মুসলিমদের উপস্থিতি টেরও পেলো না, এমনকি যখন তারা মুসলিম সেনাবাহিনীর পশ্চাতে ধূলিরাশি দেখতে পেল, তখন সে কুরাইশদের সংবাদ দেওয়ার জন্য ঘোড়া দৌড়িয়ে চলে গেল। এদিকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অগ্রসর হয়ে যখন সেই গিরিপথে পৌঁছলেন, যেখান থেকে মক্কার সোজা পথ চলে গিয়েছে, তখন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র উটনী বসে পড়ল। লোকজন তাকে (উঠাবার জন্য) ‘হাল-হাল’ বলল, কাসওয়া ক্লান্ত হয়ে পড়েছে, কাসওয়া ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘কাসওয়া ক্লান্ত হয়নি এবং তা তার স্বভাবও নয় বরং তাকে তিনিই আটকিয়েছেন যিনি হাতি বাহিনীকে আটকিয়েছিলেন।’ তারপর তিনি বললেন, ‘সেই সত্তার কসম, যাঁর হাতে আমার প্রাণ‘ কুরাইশরা আল্লাহর সম্মানিত বিষয় সমূহের মধ্যে যে কোন বিষয়ের সম্মান প্রদর্শনার্থে কিছু চাইলে আমি তা পূরণ করব।’ এরপর তিনি তাঁর উষ্ট্রীকে ধমক দিলে সে উঠে দাঁড়াল। হাদিস বর্ণনাকারী বলেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের পথ ত্যাগ করে হুদায়বিয়ার শেষ প্রান্তে অল্প পানি বিশিষ্ট কূপের কাছে অবতরণ করেন। লোকজন তা থেকে অল্প-অল্প পানি নিচ্ছিল। এভাবে কিছুক্ষনের মধ্যেই লোকজন পানি শেষ করে ফেলল এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র নিকট পিপাসার অভিযোগ করা হল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর কোষ থেকে একটি তীর বের করলেন এবং সেই তীরটি সেই কূপে নিক্ষেপ করার নির্দেশ দেন। আল্লাহর কসম! তখন পানি উপচে উঠতে লাগল, এমনকি সকলেই তৃপ্তি সহকারে পানি পান করলেন।এমন সময় বুদায়ল ইবনে ওয়ারকা খুযাঈ তার খুযাআ গোত্রের কিছু লোক নিয়ে এলো। তারা তিহামাবাসীদের মধ্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আন্তরিক হিতাকাঙ্খি ছিল। বুদাইল বলল, আমি কাব ইবনে লুওহাই ও আমির ইবনে লুওহাইকে রেখে এসেছি। তারা হুদায়বিয়ার প্রচুর পানির নিকট অবস্থান করছে। তাদের সঙ্গে রয়েছে সাবকসহ দুগ্ধবতী অনেক উষ্ট্রী। তারা আপনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে ও বায়তুল্লাহ যিয়ারতে বাধা প্রদান করতে প্রস্তুত।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘আমি তো কারো সঙ্গে যুদ্ধ করতে আসিনি; বরং উমরা পালন করতে এসেছি। যুদ্ধ নিঃসন্দেহে কুরাইশদের দূর্বল করে ফেলেছে, ফলে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তারা যদি চায়, তবে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য তাদের সঙ্গে সন্ধি করতে পারি আর তারা আমার ও কাফিরদের মধ্যকার বাধা তুলে নিবে।যদি আমি তাদের উপর জয়ী হই তবে অন্যান্য লোক ইসলামে যেভাবে প্রবেশ করেছে, তারাও চাইলে তা করতে পারবে। আর না হয়, তারা এসময়টুকুতে শান্তিতে থাকবে। কিন্তু তারা যদি আমার প্রস্তাব অস্বীকার করে, তাহলে সেই সত্তার কসম, যাঁর হাতে আমার প্রাণ, আমার গর্দান বিচ্ছিন্ন না হওয়া পর্যন্ত আমরা এ ব্যাপারে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে যাব। আর নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা তাঁর দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত করবেন।’ বুদায়ল বলল, ‘আমি আপনার বক্তব্য তাদের কাছে পৌঁছিয়ে দিব। এরপর বুদায়ল কুরাইশদের কাছে এসে বলল, ‘তাঁর পক্ষ থেকে আমাদের কাছে

তোমার কিছু বলার প্রয়োজন মনে করি না। কিন্তু তাদের বিবেকবান লোকেরা বলল, ‘তুমি তাঁকে যা বলতে শুনেছ, আমাদেরকে তা বল।’ তারপর বুদায়ল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা বলেছিলেন, সব তাদের শোনাল। তারপর উরওয়া ইবনু মাসউদ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘হে লোকেরা! আমি কি তোমাদের পিতৃতুল্য নই? তারা বলল, ‘হ্যাঁ নিশ্চয়ই। ’ উরওয়া বলল, ‘তোমরা কি আমার সন্তান তুল্য নও?’ তারা বলল, ‘হ্যাঁ অবশ্যই। ’ উরওয়া বলল, আমার সম্বন্ধে তোমাদের কি কোন অভিয়োগ আছে? তারা বলল, না। উরওয়া বলল, তোমরা কি জানো না যে, আমি তোমদের সাহায্যের জন্য উকাযবাসীদের কাছে আবেদন করেছিলাম এবং তারা আমাদের আহবানে সাড়া দিতে অস্বীকার করলে আমি আমার আত্মীয়-স্বজন, সন্তান-সন্তুতি ও আমার অনুগতদের নিয়ে তোমাদের কাছে এসেছিলাম? তারা বলল, হ্যাঁ, জানি।উরওয়া বলল, এই লোকটি তোমাদের কাছে একটি ভাল প্রস্তাব পেশ করেছেন। তোমরা তা মেনে নাও এবং আমাকে তাঁর কাছে যেতে দাও। তারা বলল, আপনি তাঁর কাছে যান। তারপর উরওয়া নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে এল এবং তাঁর সঙ্গে কথা বলতে শুরু করল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সঙ্গে কথা বললেন, যেমনিভাবে বুদায়লের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। উরওয়া তখন বলল, হে মুহাম্মদ, আপনি কি চান যে, আপনার কওমকে নিশ্চিহৃ করে দিবেন, আপনি আপনার পূর্বের আরববাসীদের এমন কারো কথা শুনেছেন যে, সে নিজ কওমের মুলোৎপাটন করতে উদ্যত হয়েছিল? আর যদি অন্য রকম হয়, (তখন আপনার কি অবস্থা হবে?) আল্লাহর কসম! আমি কিছু চেহারা দেখছি এবং বিভিন্ন ধরণের লোক দেখতে পাচ্ছি যাঁরা পালিয়ে যাবে এবং আপনাকে পরিত্যাগ করবে।তখন আবূ বকর (রাঃ) তাকে বললেন, তুমি লাত দেবীর লজ্জাস্থান চেটে খাও। আমরা কি তাঁকে ছেড়ে পালিয়ে যাব? উরওয়া বলল, সে কে? লোকজন বললেন, আবূ বকর। উরওয়া বললেন, যাঁর হাতে আমার প্রাণ, আমি তাঁর কসম করে বলছি, আমার উপর যদি আপনার ইহসান না থাকত, যার প্রতিদান আমি দিতে পারিনি, তাহলে নিশ্চই আপনার কথার জবাব দিতাম। রাবী বললেন, উরওয়া পুনরায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সঙ্গে কথা বলতে শুরু করলেন। কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দাঁড়িতে হাত দিত। তখন মুগীরা ইবনু শুবা (রাঃ) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর শিয়রে দাঁড়িয়ে ছিলেন এবং তাঁর সাথে ছির একটি তরবারী ও মাথায় ছিল লৌহ শিরস্ত্রা। উরওয়া যখনই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দাঁড়ির দিকে তার হাত বাড়াতো মুগীরা (রাঃ) তাঁর তরবারীর হাতল দিয়ে তার হাতে আঘাত করতেন এবং বলতেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দাঁড়ি থেকে তোমার হাত হটাও।উরওয়া মাথা তুলে বলল, এ কে? লোকজন বললেন, মুগীরা ইবনু শুবা। উরওয়া বলল, হে গাদ্দার! আমি কি তোমার গাদ্দারীর পরিণতি থেকে তোমাকে উদ্ধারের চেষ্টা করিনি? মুগীরা (রাঃ) জাহেলী যুগে কিছু লোকদের সাথে ছিলেন। একদিন তাদের হত্যা করে তাদের সহায় সম্পদ ছিনিয়ে নিয়েছিলেন। তারপর তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আমি তোমার ইসলাম মেনে নিলাম, কিন্তু যে মাল তুমি নিয়েছ, তার সাথে আমার কোন সর্ম্পক নেই। তারপর উরওয়া চোখের কোন দিয়ে সাহাবীদের দিকে তাকাতে লাগল। সে বলল, আল্লাহর কসম! রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো থুথু ফেললে তা সাহাবীদের হাতে পড়তো এবং তা গায়ে মুখে মেখে ফেলতেন। তিনি তাঁদের কোন আদেশ দিলে তা তাঁরা সঙ্গে সঙ্গে পালন করতেন। তিনি উযূ (ওজু/অজু/অযু) করলে তাঁর উযূর পানির জন্য তাঁর সাহাবীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হতো। তিনি যখন কথা বলতেন, তখন নিরবে তা শুনতেন এবং তাঁর সম্মানার্থে সাহাবীগন তাঁর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাতেন না।তারপর উরওয়া তার সঙ্গীদের কাছে ফিরে গেল এবং বলল, হে আমার কওম, আল্লাহর কসম! আমি অনেক রাজা বাদশাহর নিকটে প্রতিনিধিত্ব করেছি। কায়সার (রোম) কিসরা (পারস্য) ও নাজ্জাশী (আবিসিনিয়ার) সম্রাটের নিকটে দূত হিসেবে গিয়েছি; কিন্তু আমি আল্লাহর কসম করে বলতে পারি যে, কোন রাজা বাদশাহকেই তার অনুসরীদের ন্যায় এত সম্মান করতে দেখিনি, যেমন মুহাম্মদের অনুসারীরা তাঁকে করে থাকে। আল্লাহর কসম! রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যদি থুথু ফেলেন, তখন তা কোন সাহাবীর হাতে পড়ে এবং সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা তা তাদের গায়ে মুখে মেখে ফেলেন। তিনি কোন আদেশ দিলে তারা তা সঙ্গে সঙ্গে পালন করেন; তিনি ওযু করলে তাঁর ওযুর পানি নিয়ে সাহাবীগণের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়; তিনি কথা বললে, সাহাবীগণ নিশ্চুপ হয়ে শুনেন। এমনকি তাঁর সমামানার্থে তারা তাঁর চেহারার দিকেও তাকান না। তিনি তোমাদের কাছে একটি ভালো প্রস্তাব পাঠিয়েছেন, তোমরা তা মেনে নাও।তা শুনে কিনানা গোত্রের এক ব্যাক্তি বলল, আমাকে তাঁর নিকট যেতে দাও। লোকেরা বলল, যাও। সে যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবীগণের কাছে এল তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এ হল অমুক ব্যাক্তি এবং এমন গোত্রের লোক, যারা কুরবানীর পশুকে সম্মান করে থাকে। তোমরা তার কাছে কুরবাণীর পশু নিয়ে আস। তারপর তার কাছে তা নিয়ে আসা হল এবং লোকজন তালবিয়া পাঠ করতে করতে তার সামনে এলেন। তা দেখে লোকটি বলল, সুবাহান্নাল্লাহ! এমন সব লোকদেরকে কাবা যিয়ারত থেকে বাধা দেওয়া সঙ্গত নয়। তারপর সে তার সঙ্গীদের কাছে ফিরে গিয়ে বলল, আমি কুরবাণরি পশু দেখে এসেছি, সেগুলোকে কিলাদা পরানো হয়েছে ও চিহ্নিত করা হয়েছে। তাই তাদের কাবা যিয়ারত বাধা প্রদান সঙ্গত মনে করি না।তখন তাদের মধ্যে থেকে মিকরায ইবনু হাকস নামক এক ব্যাক্তি দাঁড়িয়ে বলল, আমাকে তাঁর কাছে যেতে দাও। তারা বলল, তাঁর কাছে যাও। তারপর সে যখন মুসলিমদের নিকটবর্তী হল, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘তোমাদের জন্য তোমাদের কাজ সহজ হয়ে গেল।’ মা’মার (রহঃ) বলেন, যুহরী (রহঃ) তার বর্ণিত হাদীসে বলেছেন যে, সুহায়ল ইবনু আমর এসে বলল, আসুন আমাদের অ আপনাদের মধ্যে একটি চুক্তিপত্র লিখি। তারপর নবীসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একজন লেখককে ডাকলেন। এরপরনবীসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, (লিখ)بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ এতে সুহায়ল বলল, আল্লাহর কসম! রাহমান কে? আমরা তা জানি না, বরং পূর্বে আপনি যেমন লিখতেন, লিখুনبِاسْمِكَ اللَّهُمَّ‏মুসলিমগন বললেন, আল্লাহর কসম! আমরাبِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ‏ ছাড়া আর কিছু লিখব না। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, লিখ,بِاسْمِكَ اللَّهُمَّ তারপর বললেন, এটা যার উপর চুক্তিবদ্ধ হয়েছে আল্লাহর রাসূল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তখন সুহায়ল বলল, আল্লাহর কসম! আমরা যদি আপনাকে আল্লাহর রাসূল বলেই বিশ্বাস করতাম, তাহলে আপনাকে কাবা যিয়ারত দেখে বাধা দিতাম না এবং আপনাদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে উদ্যত হতাম না। বরং আপনি লিখুন, আবদুল্লাহ পুত্র মুহাম্মদ (এর তরফ থেকে)। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘নিশ্চুই আমি আল্লাহর রাসূল কিন্তু তোমরা যদি আমাকে অস্বীকার কর তবে লিখ, আবদুল্লাহর পুত্র মুহাম্মদ।’যুহরী (রহঃ) বলেন, এটি এ জন্য যে, তিনি বলেছিলেন, তারা যদি আল্লাহর পবিত্র বস্তুগুলোর সম্মান করার কোন কথা দাবী করে তাহলে আমি তাদের সে দাবী মেনে নিব। তারপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এ চুক্তি কর যে, তারা আমাদের ও কাবা শরীফের মধ্যে কোন প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করবে না, যাতে আমরা (নির্বিঘ্নে) তাওয়াফ করতে পারি। সুহায়ল বলল, আল্লাহর কসম! আরববাসীরা যেন এ কথা বলার সুযোগ না পায় যে, এ প্রস্তাব গ্রহণে আমাদের বাধ্য করা হয়েছে। বরং আগামী বছর তা হতে পারে। তারপর লেখা হল। সুহায়ল বলল, এ-ও লিখা হোক যে, আমাদের কোন লোক যদি আপনার কাছে চলে আসে এবং সে যদিও আপনার দ্বীন গ্রহণ করে থাকে, তবুও তাকে আমাদের কাছে ফিরিয়ে দিবেন। মুসলিমগণ বললেন, সুবাহান্নাল্লাহ! যে ইসলাম গ্রহন করে আমাদের কাছে এসেছে, তাকে কেমন করে মুশরিকদের কাছে ফেরত দেওয়া যেতে পারে?এমন সময় আবূ জানদাল ইবনু সুহায়ল ইবনু আমর সেখানে এসে উপস্থি হলেন। তিনি বেড়ী পরিহিত অবস্থায় ধীরে ধীরে চলছিলেন। তিনি মক্কার নিম্নাঞ্চল থেকে বের হয়ে এসে মুসলিমদের সামনে নিজেকে পেশ করলেন। সুহায়ল বলল, হে মুহাম্মদ! আপনার সাথে আমার চুক্তি হয়েছে, সে অনুযায়ী প্রথম কাজ হল তাকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিবেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এখনো তো চুক্তি সম্পাদিত হয়নি। সুহায়ল বলল, আল্লাহর কসম! তাহলে আমি আপনাদের সঙ্গে আর কখনো সন্ধি করব না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, কেবল এ লোকটিকে আমার কাছে থাকার অনুমতি দাও। সে বলল, না। এ অনুমতি আমি দেবো না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হ্যাঁ, তুমি এটা কর। সে বলল, আমি তা করব না।মিকরায বলল, আমরা তাকে আপনার কাছে থাকার অনুমতি দিলাম। আবূ জানদাল বলেন, হে মুসলিম সমাজ, আমাকে মুশরিকদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হবে, অথচ আমি মুসলিম হয়ে এসেছি। আপনার কি দেখছেন না, আমি কত কষ্ট পাচ্ছি। আল্লাহর রাস্তায় তাকে অনেক নির্যাতিত করা হয়েছে। উমর ইবনু খাত্তাব (রাঃ) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে এলাম এবং বললাম, আপনি কি আল্লাহর সত্য নবী নন? তিনি বললেন, হ্যাঁ। আমি বললাম, আমরা কি হকের উপর নই আর আমাদের দুশমনরা কি বাতিলের উপর নন? তিনি বললেন, হ্যাঁ। আমি বললাম, তাহলে দ্বীনের ব্যাপারে কেন আমরা হেয় হবো?রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললাম, ‘আমি অবশ্যই রাসূল অতএব আমি তার অবাধ্য হতে পারি না, অথচ তিনই আমার সাহায্যকারী। আমি বললাম, আপনি কি আমাদের বলেন নাই যে, আমরা শীঘ্রই বায়তুল্লাহ যাব এবং তাওয়াফ করব। তিনি বললেন, হ্যাঁ, আমি কি এ বছরই আসার কথা বলেছি? আমি বললাম, না। তিনি বললেন, তুমি অবশ্যই কাবা গৃহে যাবে এবং তাওয়াফ করবে। উমর (রাঃ) বলেন, তারপর আমি আবূ বকর (রাঃ)-এর কাছে গিয়ে বললাম, হে আবূ বকর। তিনি কি আল্লাহর সত্য নবী নন? আবূ বকর (রাঃ) বললেন, ‘অবশ্যই।’ আমি বললাম, আমরা কি সত্যের উপর নই এবং আমাদের দুশমনরা কি বাতিলের উপর নয়? আবূ বকর (রাঃ) বললেন, নিশ্চই। আমি বললাম, তবে কেন আমরা এখন আমাদের দ্বীনের ব্যাপারে এত হীনতা স্বীকার করব?আবূ বকর (রাঃ) বললেন, ‘ওহে’ নিশ্চই তিনি আল্লাহর রাসূল এবং তিনি তাঁর রবের নাফরমানী করতে পারেন না। তিনই তাঁর সাহায্যকারী। তুমি তাঁর অনুসরণকে আকড়ে ধরো। আল্লাহর কসম! তিনি সত্যের উপর আছেন। আমি বললাম, তিনি কি বলেননি যে, আমরা অচিরেই বায়তুল্লাহ যাব এবং তার তাওয়াফ করব। আবূ বকর (রাঃ) বললেন, অবশ্যই। কিন্তু তুমি এবারই যে যাবে তিনি এ কথা কি বলেছিলেন? আমি বললাম, না। আবূ বকর (রাঃ) বললেন, তবে নিশ্চই তুমি সেখানে যাবে এবং তার তাওয়াফ করবে।যুহরী (রহঃ) বলেন যে, উমর (রাঃ) বলেছিলেন, আমি এর জন্য (অর্থাৎ ধৈর্যহীনতার কাফফারা হিসাবে) অনেক নেক আমল করেছি। বর্ণনাকারী বলেন, সন্ধিপত্র লেখা শেষ হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবাদেরকে বললেন, তোমরা উঠ এবং কুরবানী কর ও মাথা কামিয়ে ফেল। রাবী বলেন, আল্লাহর কসম! রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা তিনবার বলার পরও কেউ উঠলেন না। তাদের কাউকে উঠতে না দেখে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মে সালামা (রাঃ)-এর কাছে এসে লোকদের এ আচরণের কথা বলেন। উম্মে সালামা (রাঃ) বললেন, হে আল্লাহর নবী! আপনি যদি তাই চান, তাহলে আপনি বাইরে যান ও তাদের সাথে কোন কথা না বলে আপনার উট আপনি কুরবানী করুন এবং ক্ষুরকার ডেকে মাথা মুড়িয়ে নিন।সেই অনুযায়ী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বেরিয়ে গেলেন এবং কারো সাথে কোন কথা না বলে নিজের পশু কুরবানী দিলেন এবং ক্ষুরকার ডেকে মাথা মুড়িয়ে নিলেন। তা দেখে সাহাবীগণ উঠে দাঁড়ালেন ও নিজ নিজ পশু কুরবানী দিলেন এবং একে অপরের মাথা কামিয়ে দিলেন। অবস্থা এমন হল যে, ভীড়ের কারণে একে অপরের উপর পড়তে লাগলেন। তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে কয়েকজন মুসলিম মহিলা এলেন। তখন আল্লাহ তাআলা নাযিল করলেনঃ‏يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا جَاءَكُمُ الْمُؤْمِنَاتُ مُهَاجِرَاتٍ فَامْتَحِنُوهُنَّ হে মুমিনগণ! মুমিন মহিলারা তোমাদের কাছে হিযরত করে আসলে, …… কাফির নারীদের সাথে দাম্পত্য সম্পর্ক বজায় রেখো না। (৬ঃ ১০)সেদিন উমর (রাঃ) দু’জন স্ত্রীকে তালাক দিয়ে দিলেন, তারা ছিলেন মুশরিক থাকাকালে তার স্ত্রী। তাদের একজনকে মুআবিয়া ইবনু আবূ সুফিয়অন এবং অপরজনকে সাফওয়ান ইবনু উমাইয়া বিয়ে করেন। তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনায় ফিরে আসলেন। তখন আবূ বাসীর (রাঃ) নামক কুরাইশ গোত্রের এক ব্যাক্তি ইসলাম গ্রহণ করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে এলেন। মক্কার কুরাইশরা তাঁর তালাশে দু‘জন লোক পাঠাল। তারা (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে এসে) বলল, আপনি আমাদের সাথে যে চুক্তি করেছেন (তা পূর্ণ করুন)। তিনি তাকে ঐ দুই ব্যাক্তির হাওয়ালা করে দিলেন। তাঁরা তাকে নিয়ে বেরিয়ে গেল এবং যুল-হুলায়ফায় পৌছে অবতরণ করল আর তাদের সাথে যে খেজুর ছিল তা খেতে লাগল।আবূ বাসীর (রাঃ) তাদের একজনকে বললেন, আল্লাহর কসম! হে অমুক, তোমার তরবারীটি খুবই চমৎকার দেখছি। সে লোকটি তরবারীটি বের করে বলল, হ্যাঁ, আল্লাহর কসম! এটি একটি উৎকৃষ্ট তরবারী। আমি একাধিক বার তা পরীক্ষা করেছি। আবূ বাসীর (রাঃ) বললেন, তলোয়ারটি আমি দেখতে চাই তা আমাকে দেখাও। তারপর লোকটি আবূ বাসীরকে তলোয়ারটি দিল। আবূ বাসীর সেটি দ্বারা তাকে এমন আঘাত করলেন যে, তাতে সে মরে গেল। তার অপর সঙ্গী পালিয়ে মদিনায় এসে পৌছল এবং দাঁড়িয়ে মসজিদে প্রবেশ করল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে দেখে বললেন, এই লোকটি ভীতিজনক কিছু দেখে এসেছে।ইতিমধ্যে লোকটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে পৌছে বলল, আল্লাহর কসম! আমার সঙ্গীকে হত্যা করা হয়েছে, আমিও নিহত হতাম। এমন সময় আবূ বাসীর (রাঃ)-ও সেখানে এসে উপস্থিত হলেন এবং বললেন, ইয়া নবীয়াল্লাহ! আল্লাহর কসম! আল্লাহ আপনার দায়িত্ব সম্পূর্ণ করে দিয়েছেন। আমাকে তার কাছে ফেরত দিয়েছেন; এ ব্যাপা আল্লাহ আমাকে তাদের কবল থেকে নাজাত দিয়েছেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, সর্বনাশ! এতো যুদ্ধের আগুন প্রজ্জলিতকারী, কেউ যদি তাকে বিরত রাখত। আবূ বাসীর (রাঃ) যখন এ কথা শুনলেন, তখন বুঝতে পারলেন যে, তাকে তিনি আবার কাফিরদের কাছে ফেরত পাঠাবেন। তাই তিনি বেরিয়ে নদীর তীরে এসে পড়লেন।রাবী বলেন, এ দিকে আবূ জানদাল ইবনু সুহায়ল কাফিরদের কবল থেকে পালিয়ে এসে আবূ বাসীরের সঙ্গে মিলিত হলেন। এরপর থেকে কুরাইশ গোত্রের যে-ই ইসলাম গ্রহণ করত, সে-ই আবূ বাসীরের সঙ্গে এসে মিলিত হতো। এভাবে তাদের একটি দল হয়ে গেল। আল্লাহর কসম! তারা যখনই শুনতেন যে, কুরাইশদের কোন বানিজ্য কাফিলা সিরিয়া যাবে, তখনই তারা তাদের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতেন আর তাদের হত্যা করতেন ও তাদের মাল সামান কেড়ে নিতেন্ তখন কুরাইশরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে লোক পাঠাল। আল্লাহ ও আত্মীয়তার ওয়াসীলা দিয়ে আবেদন করল যে, আপনি আবূ বাসীরের কাছে এর থেকে বিরত থাকার জন্য নির্দেশ পাঠান। এখন থেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে) কেউ এলে সে নিরাপদ থাকবে (কুরাইশদের কাছে ফেরত পাঠাতে হবে না)।তারপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের কাছে নির্দেশ পাঠালেন। এ সময় আল্লাহ তাআলা নাযিল করেনঃوَهُوَ الَّذِي كَفَّ أَيْدِيَهُمْ عَنْكُمْ وَأَيْدِيَكُمْ عَنْهُمْ بِبَطْنِ مَكَّةَ مِنْ بَعْدِ أَنْ أَظْفَرَكُمْ عَلَيْهِمْ থেকে‏الْحَمِيَّةَ حَمِيَّةَ الْجَاهِلِيَّةِ পর্যন্ত। অর্থঃ তিনি তাদের হাত তোমাদের থেকে এবং তোমাদের হাত তাদের থেকে বিরত রেখেছেন …… জাহেলী যুগের অহমিকা পর্যন্ত ৪৮ঃ ২৬। তাদের অহমিকা এই ছিল যে, তারা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে আল্লাহর নবী বলে স্বীকার করেনি এবং মেনে নেইনি; বায়তুল্লাহ ও মুসলিমদের মধ্যে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিল।উকাইল (রহঃ) যুহরী (রহঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, উরওয়া (রহঃ) বলেন যে, আমার কাছে আয়িশা (রাঃ) বলেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলিম মহিলাদের পরীক্ষা করতেন এবং আমাদের কাছে এ বর্ণনা পৌছেছে যে, যখন আল্লাহ তাআলা নাযিল করেন, মুসলিমগণ যেন মুশরিক স্বামীদের সে সব খরচ আদায় করে দেয়, যা তারা তাদের হিযরতকারী স্ত্রীদের জন্য ব্যয় করেছে এবং মুসলিমদের নির্দেশ দেন যেন তারা কাফির স্ত্রীদের আটকিয়ে না রাখে। তখন উমর (রাঃ) তাঁর দুই স্ত্রী কুরায়বা বিনতে আবূ উমায়্যা ও বিনতে জারওয়াল খুযায়ীকে তালাক দিয়ে দেন। এরপর কুরায়বাকে মুআবিয়া ও অপর জনকে আবূ জাহাম বিয়ে করে নেয়। তারপর কাফিররা যখন মুসলিমদের তাদের স্ত্রীদের জন্য খরচকৃত অর্থ ফেরত দিতে অস্বীকার করল, তখন নাযিল হলঃوَإِنْ فَاتَكُمْ شَىْءٌ مِنْ أَزْوَاجِكُمْ إِلَى الْكُفَّارِ فَعَاقَبْتُمْ‏ তোমাদের স্ত্রীদের মধ্যে যদি কেউ হাত ছাড়া হয়ে কাফিরদের কাছে চলে যায়, তবে তার বদলা নিবে। ৬০ঃ ১১ বদলা হলঃ কাফিরদের স্ত্রী যারা হিযরত করে চলোসে, তাদের কাফির স্বামীকে মাহর মুসলিমদের যা দিতে হয়, এ সমন্ধে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নির্দেশ দেন যে, তারা যেন মুসলিমদের যে সব স্ত্রী চলে গেছে ঐ অর্থ তাদের স্বামীদেরকে দিয়ে দেয়।(যুহরী (রহঃ) আরো বলেন) এমন কোন মুহাজির রমনীর কথা আমাদের জানা নেই, যে ঈমান আনার পর মুরতাদ হয়ে চলে গেছে। আমাদের কাছে এ বর্ণণা পৌছেছে যে, আবূ বাসীর ইবনু আসীদ সাকাফী (রাঃ) ঈমান এনে চুক্তির মিয়াদের মধ্যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে হিজরত করে চলে আসলেন। তখন আখনাস ইবনু শারীক আবূ বাসীর (রাঃ) কে ফেরত চেয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট পত্র লিখল। তারপর তিনি হাদীসের অবশিষ্ট অংশ বর্ণনা করেছেন। বোখারী শরীফ হাদিস নং ২৫৪৭ ইফাবা